ইউপি নির্বাচন
হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি মামলার আসামিরাও প্রার্থী
৬ জেলার ৭ ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া ৭ চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎসহ হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎসহ হত্যা ও ধর্ষণ মামলার আসামিরা ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ মিলিয়ে ছয় জেলায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সাতজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে।
অর্থ আত্মসাৎকারী, বরখাস্তকৃতরা নির্বাচনে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বর্তমান চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। চাঁদাবাজির মামলায় কারাবরণও করেছিলেন তিনি।
গত ১১ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আবুজাফর রিপন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সড়কের উন্নয়নকাজ না করে টাকা তুলে তা আত্মসাৎ, ‘জমি আছে ঘর নাই’ প্রকল্পের আওতায় স্ত্রীর নামে একই পরিবারে দুটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া এবং সরকারি বরাদ্দের গভীর নলকূপ দুই চাচার বাড়িতে স্থাপন করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসকের সুপারিশে তাঁকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে মন্ত্রণালয়ে নিজের সব দুর্নীতি, অপকর্ম স্বীকার করে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী এমন কাজ করবেন না মর্মে মুচলেকা দিয়ে পুনরায় দায়িত্ব ফিরে পান।
এদিকে ২০১৭ সালের ২২ মার্চে স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আতোয়ার রহমান বাদী হয়ে চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে সিঙ্গাইর থানায় চাঁদাবাজির মামলা করেন। ওই মামলায় এক দিন কারাগারে ছিলেন তিনি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ ঠিক নয়। চাঁদাবাজির মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা করা হয়।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় ময়দানহাটা ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান এস এম রূপমের বিরুদ্ধে করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা প্রদানের নামে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলতে হতদরিদ্রদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ওঠে। ঘটনা তদন্তে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সত্যতা মেলে। গত বছরের ৭ জুলাই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে রূপমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযুক্ত সেই রূপম এবার দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠেয় ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে পাঠানো চিঠি সূত্রে জানা গেছে, ময়দানহাটা ইউপির চেয়ারম্যান রূপম প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলার সময় বিবিধ ট্যাক্সের নামে ১৯৮ জন উপকারভোগীর কাছ থেকে জনপ্রতি ২৮০ টাকা আদায় করেন। তদন্তে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করেন এস এম রূপম।
জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বগুড়ার সভাপতি মাসুদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সৎ ও পরিচ্ছন্ন প্রার্থীর বদলে দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিতদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে মনোনয়ন-বাণিজ্য। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে এখন আর ভোটারের সমর্থন লাগে না। টাকা আর সন্ত্রাসী বাহিনী থাকলেই দলীয় মনোনয়ন মেলে।
চাল-গম আত্মসাৎকারীরা প্রার্থী
ভিজিডির চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে মাগুরার শালিখা উপজেলায় সাময়িক বরখাস্ত তালখড়ি ইউপির চেয়ারম্যান মো. সিরাজ উদ্দিন মণ্ডলকে আবারও মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত বছর ১৬ জুলাই তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। তাঁকে বরখাস্ত করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন ভিজিডির ছয়জন উপকারভোগীর চাল বিতরণ না করে চার মাস পরিষদের একটি কক্ষে মজুত রেখেছিলেন। এই ঘটনার তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও সরকারি সম্পদ বিনষ্টের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। যে কারণে তিন মাসের মতো তিনি বরখাস্ত ছিলেন। তৃতীয় দফায় ২৮ নভেম্বর এই ইউপিতে নির্বাচন হবে। সিরাজ উদ্দিনের দাবি, ওই ঘটনা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মাত্র।
কাবিখা কর্মসূচির গম আত্মসাতের মামলা চলমান থাকা অবস্থায় নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ইউপির চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী।
খাল সংস্কারের সরকারি গম আত্মসাতের অভিযোগে ছাতনী ইউপির চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন (৬০) ও সংরক্ষিত (১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ড) নারী সদস্য শাহনাজ পারভিনকে গত বছরের ৬ আগস্ট গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সমন্বিত জেলা কার্যালয় রাজশাহীর সহকারী পরিচালক নাজমুল হুসাইন বাদী হয়ে ওই দুজনসহ চেয়ারম্যানের নাতজামাই কুরবান আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে কারামুক্ত হন। মামলাটি চলমান।
আছেন ধর্ষণ, হত্যা মামলার আসামিও
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা সদর ইউপির নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা হেভেন চৌধুরী হত্যা মামলার প্রধান আসামি হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব। এ ছাড়া ইউএনওকে লাঞ্ছিত করা, একটি জালিয়াতি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে ওই চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে।
হেভেন চৌধুরী ২০১৪ সালের ৩ মার্চ উপজেলা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুন হন। এক দিন পর নিহতের বাবা মকবুল হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে সেই সময়কার উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমানসহ ১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন।
হাবিবুর রহমান কী করে দল থেকে মনোনয়ন পেলেন, জানতে চাইলে নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল জাহান চৌধুরী বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশনায় কেন্দ্রে তাঁর নাম পাঠাতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। হাবিবুর রহমানের ভাষ্য, ষড়যন্ত্র করে তাঁকে প্রতিপক্ষের লোকজন ফাঁসিয়েছেন।
দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে নেত্রকোনার বারহাট্টায় আওয়ামী লীগের দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে দুজনকেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা হলেন বারহাট্টা সদর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী শাখাওয়াত হোসেন এবং সিংধা ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মাহবুব মুর্শেদ। শাখাওয়াত টানা দুবারের চেয়ারম্যান এবং জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। আর শাহ মাহবুব মুর্শেদ জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কাজে বাধা, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের প্রকৌশলীকে মারধর ও চাঁদাবাজির অভিযোগে শাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৩ মে মামলা হয়। ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে গত ২০ জুন নিম্ন আদালতে হাজিরা দিতে গেলে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে। শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমার ওপর মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল।’
কিশোরী গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে শাহ মাহবুব মুর্শেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০২০ সালের ১১ মে মারুফার মা বাদী হয়ে মোহনগঞ্জ থানায় মামলাটি করেন। পরে পুলিশ ওই দিন রাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু ১৪ মে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এর আগেও সরকারি গাছ কাটা, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সিল ও সই নকল করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে গত ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে পুনরায় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি।
জাপার মনোনয়নেও বিতর্কিত ব্যক্তি
জন্মনিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স বাবদ ৩৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার বন্দর ইউপির দুবারের চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি উচ্চ আদালতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশের বিরুদ্ধে রিট করলে তিন মাসের জন্য তা স্থগিত হলে আবার তিনি চেয়ারম্যান পদ ফিরে পান।
বন্দর ইউপিতে দ্বিতীয় দফায় আগামী ১১ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবারও এহসান বন্দর ইউপির নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।
এহসান উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ৩৪ লাখ টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইউপি সচিব ইউসুফ হোসেনকে বরখাস্ত করেছে। তাঁকেও ওই ঘটনায় সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। বরখাস্তের ওই আদেশ উচ্চ আদালতে স্থগিত আছে বলে দাবি করেন তিনি।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া, প্রতিনিধি, নাটোর, মানিকগঞ্জ, মাগুরা, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা]