ভুঁইফোড় সংগঠনে অতিষ্ঠ আ.লীগ, নিচ্ছে আইনি ব্যবস্থা
নামের আগে-পরে ‘আওয়ামী’, ‘লীগ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ যুক্ত করে ২০০৯ সালের পর যেসব সংগঠন গড়ে উঠেছে, এর প্রায় সবই ভুঁইফোড় বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্যোক্তাদের কর্মকাণ্ড ও সম্পদের খোঁজ নেওয়া হবে। সরকার বা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসব সংগঠনের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, সেটাও খোঁজা হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তাঁর মালিকানাধীন জয়যাত্রা আইপি টিভি ও জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ভবনে অভিযান চালায় র্যাব। সূত্র বলছে, এর মাধ্যমে ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা শুরু হলো।
সম্প্রতি ফেসবুকে নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এরপর তাঁকে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ এ নিয়ে তিনবার সরকার গঠন করেছে। প্রতিবার নির্বাচনের আগে বা সরকার গঠনের পর কিছু সংগঠন গজিয়ে ওঠে। মূলত, মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া কিংবা বাদ পড়া এবং দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের কেউ কেউ এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ২০১৫ সালে দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে শতাধিক সংগঠনের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়।
এরপর কিছুদিন এদের তৎপরতা কিছুটা কমে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে পুনরায় তৎপর হয়ে ওঠে। প্রচারের লোভে এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে গিয়ে দু-একজন মন্ত্রী-নেতা প্রতারিত হওয়ার কথাও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে তুলেছেন। সরকারি কর্মকর্তারাও ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের তদবিরে অতিষ্ঠ হয়ে নালিশ করেছেন। এরপর সম্প্রতি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে পুনরায় ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, নামের আগে-পরে লীগ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল এবং মুক্তিযুদ্ধ যুক্ত করে সারা দেশে গড়ে ওঠা ভুঁইফোড় সংগঠনের সংখ্যা শতাধিক। এর বেশির ভাগই গত এক দশকে গড়ে উঠেছে। ফেসবুকে একটি পেজ কিংবা দিবসভিত্তিক কিছু ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে তারা তৎপর থাকে। নামসর্বস্ব এসব সংগঠনকে আওয়ামী লীগের অনেকেই ‘রাজনৈতিক দোকান’ বলে মন্তব্য করেন। এসব ‘দোকানের’ আয়োজিত অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হিসেবে আওয়ামী লীগের ডজনখানেক নেতা ও বর্তমান–সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে যাঁরা মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই পাননি বা বাদ পড়েছেন, এমন নেতাদের বেশি দেখা যায়। কোনো কোনো ভুঁইফোড় সংগঠনের নাম নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে হাস্যরসে মেতে উঠতেও দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের কার্যত কোনো কমিটি, কার্যালয় বা গঠনতন্ত্র নেই। কিছু সংগঠন ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে তাদের দলীয় কার্যালয় হিসেবে প্যাডে উল্লেখ করে থাকে। ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের’ চেতনায় বিশ্বাসী উল্লেখ করে সুবিধা আদায় করার অভিযোগ আছে এসব কথিত সংগঠনের বেশ কয়েকটির বিরুদ্ধে। দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠান বা চলমান রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনার নামে জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠান ও মানববন্ধন কর্মসূচি দেখা যায়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাঠে রাজনীতি করি। এসব ভুঁইফোড়, স্বার্থান্বেষীরা কখন কোথায় ছবি তুলে বসে, সেই আতঙ্কে থাকি।’ তিনি আরও বলেন, এসব ভুঁইফোড় সংগঠন আওয়ামী লীগকে বিব্রত করছে। তাদের বিরুদ্ধে দল কঠোর। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দলটির রাজনীতির ওপর নানা ধরনের ধমন-পীড়ন চলে। এ সময় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব সংগঠনের নামের আগে-পরে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম আছে। এ সংগঠনগুলো দুর্দিনে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এসব সংগঠন আওয়ামী লীগের সহযোগী কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম মর্যাদা না পেলেও দলের নীতিনির্ধারকেরা মর্যাদার চোখে দেখেন। এদের কর্মকাণ্ডকে মূল্য দেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শেখ রাসেল শিশু-কিশোর, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলাসহ কয়েকটি সংগঠন বেশ পুরোনো। এগুলোর বিষয়ে দলের নেতাদের মনোভাব ইতিবাচক। কিন্তু ২০০৯ সালের পর প্রায় এক যুগ ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ সময় বেশির ভাগ সংগঠনই গড়ে তোলা হয়েছে তদবির –বাণিজ্যের লক্ষ্যে।
এর বাইরে আওয়ামী ওলামা লীগ দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সহানুভূতি পেয়ে আসছিল। কিন্তু সংগঠনে বিভক্তি একপর্যায়ে সংঘাতে রূপ নেয়। এ ছাড়া তারা মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণে বিরোধিতা, ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের আইন প্রণয়নের দাবি, পয়লা বৈশাখবিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়, যা হেফাজতে ইসলামসহ অন্য ধর্মীয় সংগঠনের কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০১৭ সালে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ওলামা লীগের কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়ার নির্দেশনা দেন। এরপর আর তাদের মাঠে দেখা যায় না। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ আওয়ামী লীগের সহযোগী কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নয়। তবে সংগঠনটি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে।
কয়েক বছর ধরে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আওয়ামী লীগ সমর্থক জোট নামে একটি সংগঠন। নামসর্বস্ব ৩৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের আহ্বায়ক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক আবদুল হক সবুজ। কৃষক লীগের সাবেক নেতা এম এ করিমের ৩৪টি কাগুজে সংগঠন বা রাজনৈতিক ‘দোকান’ থাকার কথা জানা যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। তিনি ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে রাজনীতি করেছেন। কোনো সুবিধা নেননি।
হুমায়ুন কবির মিজি ও জাকির আহমেদকে একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখা যায়। হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন করছেন। প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমুসহ অনেক নেতা তাঁর কর্মসূচিতে এসেছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও অতীতে বহুবার তাঁর কর্মসূচিতে এসেছেন। তিনি দাবি করেন, তিনি কোনো সুবিধা নেননি। করোনার সময় ঘরভাড়া দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, এখন যেভাবে নতুন নতুন ‘দোকান’ শুরু হয়েছে, তাতে তাঁরা বিপদে পড়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে দল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরা দল বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধার ধারে না। নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতাকেও এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে যেতে দেখা যায়। অনেকেই পরে মন্ত্রিসভার সদস্য হন। ২০১৪ সালের পর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া অন্য নেতারা পুনরায় এসব সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। পরে তাঁদের অনেকেই ২০১৮ সালে মন্ত্রিসভায় স্থান পান।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ভুঁইফোড় সংগঠনকে মন্ত্রী হওয়ার ‘মঞ্চ’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। কারণ, অনেকেই এসব সংগঠনে ‘গরম’ বক্তৃতা করার পর মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করারও অভিযোগ আছে। মন্ত্রী হওয়ার পরও কেউ কেউ এ সম্পর্ক ধরে রাখেন। এ সুযোগ নেন সংগঠনের উদ্যোক্তারা। করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে সভা-সমাবেশ অনেকটাই কমে গেছে। এখন তাঁরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সক্রিয়।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠন আটটি। এগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে দুটি—ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ।
এর বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’–এর অনুমোদন নিতে হয়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত সংগঠনের ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো অনুমোদনের ধার ধারে না।