২০২১ সালের জন্য দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিএনপি। এই সময়ে দলটি সারা দেশের কমিটিগুলো পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে কার্যক্রম শুরু করেছে। পাশাপাশি স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বছরব্যাপী সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা কর্মসূচিতে মাঠে থাকার পরিকল্পনা করছে। একই সঙ্গে সরকার বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্য ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামতে চায় দলটি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তাই বেশ কিছুদিন থেকেই দল গোছানোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই চলতি বছরের মধ্যে মূল দল এবং কয়েকটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে চায় দলটি। পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দলীয় ঐক্যের দিকে। তাই বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে ক্ষুব্ধ ও মনঃক্ষুণ্ন হয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন, এমন জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। তারই অংশ হিসেবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে শীর্ষ নেতৃত্বের যোগাযোগ হয়।
সম্প্রতি দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। হাফিজ উদ্দিন আহমদ দলের কিছু নীতি-কৌশলের সমালোচনা করেছিলেন। আর শওকত মাহমুদ দলের অগোচরে ঢাকায় সরকার পতনের লক্ষ্যে আচমকা জমায়েতের আয়োজন করেছিলেন। দুজনেই নোটিশের জবাব দিয়েছেন। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমদকে নোটিশ পাঠানোর ঘটনায় দলের ভেতরে–বাইরে প্রতিক্রিয়া হয়। এর আগে আরেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যদিও নিজের বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন শাহ মোয়াজ্জেম।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, সর্বশেষ হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে নোটিশ দেওয়া এবং তাঁদের জবাবের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে দলের কোনো পর্যায়ে আলোচনা হয়নি। এ নিয়ে আর কোনো কথাবার্তাও নেই। নতুন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে এ বিষয়ে আর আগ বাড়াবেন না দলের নীতিনির্ধারকেরা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলকে সংঘবদ্ধ করার কাজ চলছে। মেজর হাফিজ সাহেবের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটি কমে গেছে। তিনি দলের সঙ্গে আছেন।’
দলীয় সূত্র জানায়, সারা দেশে বিএনপির জেলা, মহানগর ও থানার কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলছে। এর আগে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পুনর্গঠন শুরু করেছিল। মাঝে করোনার জন্য প্রায় ছয় মাস কার্যক্রম বন্ধ ছিল। বর্তমানে তিন সংগঠনের পুনর্গঠন কাজ শেষ পর্যায়ে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক জায়গায় ১০-১২ বছর ছাত্রদলের কমিটি ছিল না বা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন থানা, পৌরসভা, উপজেলা ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠনের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ হয়েছে।
দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকার পর সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন বিষয়ে মানববন্ধনসহ একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এখন দলের নীতিনির্ধারকেরা বছরব্যাপী কর্মসূচির পরিকল্পনা করছেন। বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কর্মসূচিসহ নানা ইস্যু ধরে আবার মাঠে থাকার লক্ষ্য ঠিক করছেন। এর মধ্যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বছরব্যাপী সভা-সেমিনারসহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে সক্রিয় থাকবে। এসব সভা-সেমিনারে স্বাধীনতাসংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসের পাশাপাশি বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অর্জনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান এবং তাঁর দর্শন ও আদর্শকে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামী মার্চ মাস থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচি শুরু হবে, শেষ হবে ১৬ ডিসেম্বর। সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনে ইতিমধ্যে ১০টি বিভাগীয় এবং ১৫টি বিষয়ভিত্তিক কমিটি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সমন্বয় কমিটিও করা হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বিভিন্ন দেশেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি হবে বছরব্যাপী। এতে সমাবেশ, সেমিনার, প্রকাশনী, চিত্র প্রদর্শনী, ডকুমেন্টারি, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সব কার্যক্রম থাকবে।’
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালে দল গোছানোর কাজ শেষ করার পাশাপাশি তাঁদের একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে সরকারবিরোধী বড় ঐক্য গড়ে আন্দোলনে নামা। এ লক্ষ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বাইরে থাকা একাধিক দলের নেতাদের সঙ্গে পৃথক আলোচনা হয়েছে। ইতিমধ্যে ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য খসড়া সুপারিশমালাও তৈরি করা হয়েছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে যে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি চলছে, তাতে একটি গণতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ নেই। বিরোধী দলের স্বাভাবিক কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা সব দলকে নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছি। এ জন্য আলোচনা শুরু করেছি।’
অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী মনে করেন, বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চাইলে অন্য দলগুলোর কাছ থেকে বিএনপি সাড়া পাবে। কিন্তু আন্দোলন গড়ে তোলা কঠিন হবে। আবার এর বিকল্পও নেই।