রাবির আবাসিক হল
প্রাধ্যক্ষরাও ‘অসহায়’ ছাত্রলীগের কাছে
চার বছর আগে সিট বরাদ্দ পেয়েও উঠতে পারছেন না অনেক শিক্ষার্থী। হলের প্রাধ্যক্ষরা ছাত্রলীগের কাছে অনেকটা ‘অসহায়’।
আবাসিক হল আছে ১৭টি। এর মধ্যে ছাত্রদের হল ১১টি। সিট আছে ৫ হাজার ৩৯৩টি।
হল প্রাধ্যক্ষকে বললে তাঁরা ‘বড় ভাইদের’ (ছাত্রলীগ নেতা) ধরে হলে ওঠার পরামর্শ দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সিট পেতে হল প্রশাসনের অনুমতির পাশাপাশি ছাত্রলীগের সম্মতিও লাগে। ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের সম্মতি ছাড়া শিক্ষার্থীরা হলের সিট পান না বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার এক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেন ছাত্রলীগের এক নেতা। অবশ্য দিনভর হলের বাইরে কাটানোর পর সন্ধ্যায় ওই ছাত্র হলে উঠতে পেরেছেন।
অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, আবাসিক হলে সিট বরাদ্দ পেয়ে প্রতি মাসে টাকা গুনছেন ঠিকই। কিন্তু সিট পাচ্ছেন না। উল্টো মেসভাড়া দিচ্ছেন। হল প্রাধ্যক্ষকে বললে তাঁরা ‘বড় ভাইদের’ (ছাত্রলীগ নেতা) ধরে হলে ওঠার পরামর্শ দেন।
শের–ই–বাংলা ফজলুল হক হলে এক মাস আগে সিট বরাদ্দ পেয়েছেন কলা অনুষদের একটি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী। কৃষক বাবার ওই সন্তান এখনো হলে উঠতে পারেননি। তাঁর ভাষ্য, প্রাধ্যক্ষের কাছে অনেকবার গেছেন। কিন্তু প্রাধ্যক্ষ কোনো বড় ভাইকে ধরে হলে উঠতে বলেছেন।
গতকাল সকালে শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হলের একটি কক্ষ থেকে আবাসিক এক শিক্ষার্থীকে তাঁর বাক্সপেটরাসহ বের করে দেন ছাত্রলীগের হল শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে রাতুল।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আকিব জাবেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বরাদ্দ করা কক্ষ ছিল ১২৯ নম্বর। সারা দিন বাইরে অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় হল প্রশাসন তাঁকে ২৪২ নম্বর কক্ষে তুলে দিয়েছে।
সন্ধ্যায় ওই শিক্ষার্থীকে হলে তোলার সময় হল প্রাধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান ছাড়াও ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক তারেক নূর, সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
হল প্রাধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বলেন, আকিবকে একটি কক্ষে তাঁরা তুলে দিয়েছেন। এখন তাঁরা দেখবেন, ঘটনাটি কেন কীভাবে ঘটল।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আবাসিক হল আছে ১৭টি। এর মধ্যে ছাত্রদের ১১টি, ছাত্রীদের ৬টি। আর সিট আছে ৯ হাজার ৪৭৮টি। এর মধ্যে ছাত্রী হলে ৪ হাজার ৮৫টি এবং ছাত্র হলে ৫ হাজার ৩৯৩টি সিট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৮ হাজারের বেশি। ছাত্রদের আবাসিক হলের বেশির ভাগ সিট ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে প্রতিটি হলের একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন।
২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী ২০১৯ সালে মাদার বখ্শ হলে সিট পান। হলে ভর্তি হতে প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হয় তাঁর। তিনি হলে গিয়ে দেখেন, তাঁর সিট ছাত্রলীগের মাধ্যমে অন্য একজন দখল করেছেন। হল প্রাধ্যক্ষের কাছে গেলে প্রাধ্যক্ষ নিজ দায়িত্বে সিট খুঁজে নেওয়ার কথা বলেন। এই শিক্ষার্থী বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষেরা ছাত্রলীগের কাছে অসহায়।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন এ কমিটিকে হল প্রাধ্যক্ষকে সহযোগিতা করার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। তাঁদের কাছেও অনেকে আসন না পেয়ে আসেন, তাঁরা আসন পেতে সহযোগিতা করেন। তবে ছাত্রলীগের কেউ অনাবাসিক নেই। কারও দখলে আসনও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮–১৯ শিক্ষাবর্ষের একজন শিক্ষার্থী শহীদ জিয়াউর রহমান হলে দুই মাস আগে আসন বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনি জানান, তাঁর বাবা ঢাকায় রিকশা চালান। সেই আয়ে চলে পরিবারের পাঁচ সদস্যের। আর আয়ের একটি অংশ তাঁর পড়াশোনার জন্য পাঠান। হলে আসন পাওয়ার খবরে বাবা খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু দুই মাস ধরে ঘুরেও তিনি কোনো আসনে উঠতে পারেননি। উল্টো হল এবং মেসভাড়া—দুটিই বহন করতে হচ্ছে তাঁর বাবাকে।
ওই শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, হল কর্তৃপক্ষ এক বিকেলে তাঁকে হলে তুলে দেয়। কিন্তু রাত না হতেই তাঁকে নামিয়ে দেয় ছাত্রলীগ। তারপর প্রাধ্যক্ষের কাছে গেলে প্রাধ্যক্ষ ধৈর্য ধরতে বলেন।
জিয়াউর রহমান হলে গত ৮ ফেব্রুয়ারি আসন বরাদ্দের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে হলে অবস্থানকারী অনেক অনাবাসিক ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীর কক্ষেও শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর গত কয়েক দিনে হল প্রশাসন অনাবাসিক ছাত্রলীগ কর্মীদের আসন থেকে নামিয়ে আবাসিক ছাত্রদের তুলে দেয়। এ ঘটনায় পরে প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলনও করে ছাত্রলীগ। হলের প্রাধ্যক্ষ সুজন সেন বলেন, ধীরে ধীরে হলে বরাদ্দ দেওয়া শিক্ষার্থীদের তোলা হচ্ছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী বাকি আছেন। তাঁদেরও তোলার প্রক্রিয়া চলছে। আগে একটু ঝামেলা হয়েছিল। এখন আর নেই।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক ও শহীদ হবিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মো. জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হলে আসনের জন্য প্রচুর আবেদন আসছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় হলে কক্ষ কম। বরাদ্দের পর সিট খুঁজে নিতে প্রাধ্যক্ষদের নির্দেশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না। সব হলে এক রকম না। সিটে যাতে প্রাধ্যক্ষই দায়িত্ব নিয়ে তুলে দেন, এ নিয়ে সামনে প্রাধ্যক্ষ পরিষদের সভায় কথা বলব।’