হট্টগোলের পর কুমিল্লায় মেয়র পদে আরফানুলকে বিজয়ী ঘোষণা
ভোট গ্রহণ নিয়ে কোনো প্রার্থীরই তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। ভোটের ফলাফল ঘোষণার শুরুর দিকেও পরিস্থিতি ছিল শান্তিপূর্ণ। তবে ফল ঘোষণার একেবারে শেষ দিকে এসে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মনিরুল হকের কর্মী-সমর্থকেরা মুখোমুখি হয়ে পড়েন। হইচই, হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলার কারণে কিছু সময় ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা।
শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে মনিরুলকে হারিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন নৌকা প্রতীকের আরফানুল হক (রিফাত)। তিনি পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী টেবিলঘড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা মনিরুল হক (সাক্কু) পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট।
বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে কুমিল্লা শহরের শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী বেসরকারিভাবে এই ফলাফল ঘোষণা করেন। এ সময় মনিরুল হক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ফল ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাকে পরিকল্পিতভাবে হারানো হয়েছে।’
কুমিল্লার ভোট হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। মোট ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪ জন ভোট দিয়েছেন। ৩১৯ ভোট বাতিল হয়েছে। ভোট পড়ার হার ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
আরফানুল হকের এই জয়ে পরপর দুবার মেয়র পদে নির্বাচিত মনিরুল হকের ‘হ্যাটট্রিক’ করা আর হলো না। একই সঙ্গে এই জয়ের মধ্য দিয়ে কুমিল্লা সিটিতে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী জয়ী হলেন। এর আগে মনিরুল হকের সঙ্গে নির্বাচনে প্রথমে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফজল খান এবং পরে তাঁর মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা হেরেছিলেন। আফজল খানকে ২৯ হাজার ১০৬ ভোটে হারিয়ে প্রথমবার মেয়র হন মনিরুল। দ্বিতীয়বার আঞ্জুম সুলতানার সঙ্গে ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন তিনি।
চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর আরফানুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এই বিজয় কুমিল্লাবাসীর। কুমিল্লার মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। এ বিজয় কুমিল্লার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
ভোটের ফল ঘোষণার পর আরফানুল হক শহরের কান্দিরপাড়-রাজগঞ্জ সড়কের বাসা থেকে সরাসরি চলে যান স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মুন্সেফবাড়ী এলাকার বাসায়। সেখানেই তিনি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
নির্বাচনে মেয়র পদে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন (ঘোড়া) পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট। এ ছাড়া মেয়র পদে হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মো. রাশেদুল ইসলাম ৩ হাজার ৪০ ভোট ও স্বতন্ত্রী প্রার্থী কামরুল আহসান (হরিণ) ২ হাজার ৩২৯ ভোট পেয়েছেন। মূলত নিজামের এই ভোটই মনিরুল হককে হারাতে এবং আরফানুলকে জয়ী করতে ভূমিকা রেখেছে। কারণ, মনিরুল হক ও নিজাম উদ্দিন—দুজনেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় দুজনকেই বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তবে নির্বাচনে দুজনেরই ভোটের উত্স ছিল বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভোট। দুজন মিলে ভোট পেয়েছেন ৭৯ হাজার ৬৬ ভোট, যা আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে ২৮ হাজার ৭৫৬ ভোট বেশি।
কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত ভোট গণনাকেন্দ্রে থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। গত রাত পৌনে নয়টার দিকে যখন ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী। এ সময় তিনি মাইকে ঘোষণা করেন, চারটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা বাকি আছে। এসব কেন্দ্রের ফল তাঁর হাতে এসে পৌঁছায়নি। তিনি তখন কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফল ঘোষণার কথা বলেন।
তাঁর এই ঘোষণার পর মিলনায়তনে উপস্থিত থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হকের অনুসারীরা হইচই করেন, স্লোগান দেন। তাঁরা এ সময় মেয়র প্রার্থীর ফল ঘোষণা করার দাবি জানান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। এ সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁদের আশ্বাস দেন, মেয়র প্রার্থীর ফলই আগে ঘোষণা করা হবে।
এর কিছুক্ষণ পর রাত পৌনে নয়টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক তাঁর অনুসারী কিছু নেতা–কর্মীদের নিয়ে নির্বাচনের ফল ঘোষণাস্থলে (শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন) আসেন। এ সময় মনিরুল হকের অনুসারীদের একটা অংশকে পুলিশের সদস্যরা মিলনায়তন থেকে বের করে দেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা এরপর আরও দুটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেন। এ সময় রাত নয়টার দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক (রিফাত) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। তবে নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের ভেতরে প্রবেশে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি।
আরফানুলের সমর্থকেরা এ সময় নৌকা মার্কার স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের সঙ্গে টেবিলঘড়ি প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হলে সেখানে থাকা পুলিশের সদস্যরা সবাইকে হল থেকে বের করে দেন। মিলনায়তনের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে পড়ে।
এসব বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করতেই মিলনায়তনে নৌকার প্রার্থীরা এসেছেন। ফল ঘোষণা না নিয়ে তিনি সে স্থান ত্যাগ করবেন না।
পরে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হককে ৩৪৩ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।