ইতালি থেকে বলছি
আমি ইতালির ইমিলিয়া-রোমানিয়া অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র বোলোনিয়া শহর থেকে বলছি। শহরটি করোনাভাইরাস–অধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। আমি ও আমার পরিবার প্রায় এক মাস ধরে নিজ ঘরে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছি।
২১ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার দিনটি খুব ভালোভাবে কেটেছিল। আমরা সপ্তাহের শেষ ক্লাস করে বন্ধুরা আসন্ন এক উৎসবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তখনো জানতাম না, এদের অনেকের সঙ্গেই আমার শেষ দেখা হতে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর শুনলাম, করোনাভাইরাসে ইতালিতে ৩৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। খুব একটা পাত্তা দিইনি, মনে করেছিলাম ভুয়া খবর। কারণ, আমি সকালেও জানতাম, ইতালিতে মাত্র ২ জন আক্রান্ত হয়েছে।
পরদিন সকালেই খবর পেলাম, দুজন মারা গেছে আর করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। শনিবার বোলোনিয়াতে উৎসব ছিল, সকাল থেকে সেই প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত ছিল শহরের মানুষ। কিন্তু দুপুরের পর সব থেমে গেল। দুপুর পর্যন্ত আমি মোটামুটি চিন্তামুক্ত ছিলাম, দুপুরের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ই-মেইল আসার পর বুঝলাম, অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ করে উত্তর ইতালির স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে রীতিমতো সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিল। সব ধরনের ট্যুর বন্ধ হয়ে গেল। অনেকেই হয়তো জানেন, ইউনিভার্সিটি অব বোলোনিয়ার জন্য বোলোনিয়া শহর বিখ্যাত, শিক্ষার্থীরা এই শহরের প্রাণ। সন্ধ্যার পর আমার বন্ধুরাসহ প্রায় সব শিক্ষার্থীই নিজ নিজ শহরে চলে যাওয়া শুরু করল। শহর প্রায় শূন্য হয়ে গেল।
২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘুমানোর আগে দেখলাম, অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ইতালির কিছু অঞ্চলের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আশপাশের শহরে খাবার নেই। পরিবর্তনটা যেন চোখের পলকে হচ্ছিল। পরের দিন সকালে উঠেই বাজার করতে গেলাম, গিয়ে দেখি সব সুপারশপ প্রায় খালি। অনেক পরিবারকে দেখেছি অসহায়ের মতো কিছু না কিনেই ফিরে এসেছে, এদের মধ্যে কিছু বাংলাদেশি পরিবারও ছিল।
শুরুতে ইতালির উত্তরাঞ্চলে ভাইরাস ছড়ালেও দুদিন পর সব অঞ্চলেই ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে। আয়ারল্যান্ডসহ কিছু দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুরু হয় মানুষের গৃহবন্দী জীবন। রাস্তায় কোনো মানুষ নেই, কোলাহল নেই। এই মৃত নগরী আমার অচেনা। শুধু মনে হচ্ছিল, সব খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে! প্রথম দিকে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব থেমে যাচ্ছিল।
১৮ মার্চ ছিল আমার অবরুদ্ধ জীবনের ২৫তম দিন। আমি যখন এই লেখা টাইপ করছি, তখন পর্যন্ত ইতালিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩১ হাজার ৫০৬; আর মারা গেছে ২ হাজার ৫০৩ জন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টাতেই মারা গেছে ৩৪৫ জন (গতকাল ২০ মার্চ পর্যন্ত ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৩৫ জনে, মারা গেছেন ৩ হাজার ৪০৫ জন মানুষ)। হয়তো জানেন, মানসম্পন্ন মেডিকেল সামগ্রীর জন্য দুনিয়াজোড়া ইতালির খ্যাতি আছে। তবু কী করুণ দশা। ইতালিতে এখন শুধু ওষুধের দোকান, কিছু সুপারমার্কেট (খুব কম যদিও) আর গণমাধ্যম ও পোস্ট অফিস খোলা আছে। এসব জায়গায় যাঁরা কাজ করছেন, সবাই দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগই নেই, এমনকি অসুস্থতা বোধ করলে বাসায় চিকিৎসক পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। জরুরি নম্বরে ফোন দেওয়ার ৫-১০ মিনিটের মধ্য অ্যাম্বুলেন্সসহ ডাক্তার চলে আসেন। বাসা থেকে জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হলে আমাদের নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করতে হয়। অন্যথায় গুনতে হবে ২০৬ ইউরো জরিমানা।
এখন আমাদের সকাল শুরু হয় সারা দিন কী খাব সেই চিন্তায়, রাত শেষ হয় পরের দিন কী খাব সেই হিসাব করে। এখন পর্যন্ত আমাদের বাসায় আগামী এক মাস চলার মতো খাবার আছে। তারপর কী হবে আমরা কিছুই জানি না। যোগাযোগ বন্ধ থাকায় অন্য শহর থেকে খাবার আসারও কোনো সুযোগ নেই।
মৃত্যুর মিছিলের সঙ্গে এই শহরের জীবনের স্পন্দন প্রায় থেমেই গিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, এত কিছুর মধ্যেও আমরা মনোবল হারাইনি। প্রতিদিন দুবার এই শহরে কনসার্ট হয়! প্রতিদিন সকালে উঠে সবাই জোরে চিৎকার করে শুভসকাল জানায় সবাইকে, জানায় যে আমাদের সকাল এখনো আগের মতোই সুন্দর। আর সন্ধ্যা ছয়টা বাজে শুরু হয় প্রথম দফার কনসার্ট। সবাই জানালা খুলে নানা রকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পুরো শহরকে একসঙ্গে গানের তালে তালে জাগিয়ে তোলে। আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পুরো শহরের কৃত্রিম আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে গানের তালে মেতে ওঠে। তখন যদি অচেনা কেউ এই শহরে আসে, বুঝতেই পারবে না শত শত প্রিয়জন হারানোর বেদনা মানুষের মনে। তবে এত দুঃখের মধ্যেও এই সময়ে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাঁদের আমরা ভুলে যাইনি। গত পরশু দিনই সেই সব ডাক্তার, নার্সের উদ্দেশে পুরো দেশের মানুষ একসঙ্গে তালি দিয়ে তাঁদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছি।
সবশেষে আমার দেশের মানুষকে বলি, আপনারা অনুগ্রহ করে এখনই সচেতন হোন। ইতালির মতো দেশ মাত্র ৫ সপ্তাহে শেষ হয়ে গেছে, চলছে ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডি। আপনারা বুঝতেও পারছেন না অবরুদ্ধ অবস্থা কত কষ্টের। প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। এই ঝড় যে আমার কত কাছের বন্ধুদের নিয়ে যাবে, তাদের পরিবারকে নিয়ে যাবে। এই তো সেদিনই শুনলাম, আমাদের এক বন্ধুর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ মনে হয় এই তো সেদিন কথা বলেছি। জানি না আমাদের আর দেখা হবে কি না! চারপাশে এত অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনতে শুনতে আমার এখন অসুস্থতা বোধ হয়। আমার যখন খুব ভয় লাগে, তখন টানা ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। কিছুদিন আগেও খুব সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখতাম, এখন দুঃস্বপ্ন দেখে প্রতিদিন ঘুম ভাঙে। জানি না কবে সকালে উঠে দেখব পৃথিবীটা আবার আগের মতো সুন্দর, কর্মচঞ্চল।
ফৌজিয়া করিম
শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব বোলোনিয়া, ইতালি
১৮ মার্চ ২০২০