কুমড়োর রাজ্যে
খবর পেলাম শহরে নাকি সার্কাস দল এসেছে! তা–ও আবার জার্মানির এক রূপকথার রাজ্যে। পাহাড়ের কোলঘেঁষা সবুজ ছোট্ট শহর কাইজারস্লটার্ন। সেখানকার কথাই বলছি। শহরের শেষ প্রান্তে এক বাগানের নাম গারটেনশাও। হেমন্তের নতুন ফসল ঘরে তোলার খুশিতে আমরা যেমন নবান্ন উৎসবে মেতে উঠি, ঠিক তেমনি জার্মানিতে সবাই মেতে ওঠে কুমড়ো উৎসবে। জার্মান ভাষায় এর নাম কুরবিস ফেস্টিভ্যাল।
শুধু জার্মানি নয়, মিষ্টি রোদের সোনালি হেমন্ত উৎসব আয়োজন করা হয় ইউরোপ–আমেরিকার বহু দেশে। কোথাও কোথাও ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত আবার একেবারে হ্যালোইনের আগের দিন পর্যন্ত চলে এই উৎসব।
জার্মানির কাইজারস্লটার্ন শহরে প্রতিবছরই সাজানো হয় রূপকথার কুমড়োরাজ্য। ১৫০ জাতের ৫০ হাজারেরও বেশি কুমড়ো দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় এই রূপকথার রাজ্য। বিভিন্ন আকৃতির মিষ্টিকুমড়োয় সাজানো হয় রূপকথার চরিত্রদের। সেই রাজ্যে এবার এসেছে সার্কাসের দল। তাই দলেবলে আমরাও গিয়ে হাজির হলাম সেখানে। আমার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশি এক বন্ধু সামিনা। দুজন মিলে যে–ই সামনের দিকে পা বাড়ালাম, অমনি দেখা হলো সঙ সাজা এক মানুষের সঙ্গে। সে কুমড়োরাজ্যের প্রবেশমুখে রং মেখে সঙ সেজে চাকা ঘুরিয়ে খেলা দেখাচ্ছিল। ভাবখানা এমন, যেন সে ডাকছে সবাইকে, খেলা দেখে যান বাবু। তার পরনে কমলারঙা কুমড়োর জামা আর হালকা সবুজ কুমড়োর পায়জামা আর মাথায় সবুজ টুপি।
পাথুরে পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে সবুজ সমতলে উত্তুরে হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল সার্কাস অন্য সবাই। কিছুদূর এগোতেই মেটে রঙা কুমড়োর পোশাকে লম্বা লাঠি হাতে প্রহরী। কুমড়োরাজ্যে কুমড়ো মেলায় ঘুরতে এসেছেন বড়–ছোট সবাই। শুধু এই শহর নয়, আশপাশের শহর থেকে এসেছেন ছেলে–বুড়ো সবাই।
প্রবেশপথে যাওয়ার পথেই নানা আকারের কুমড়ো প্রদর্শনী ছিল নান্দনিক সাজে সজ্জিত। পুতুল আর ফুলে পানির ফোয়ারার পাশে বিভিন্ন জাতের কুমড়োর চাষাবাদ, উৎপত্তি, প্রতীকী খামারের দৃশ্য ছিল মনোরম। কুমড়ো জ্ঞানে যথাসম্ভব বিদ্বান হয়ে আমরা হাঁটা দিলাম সামনের দিকে। পথের ধারে বিশাল বিশাল আকৃতির গোটা চারেক কুমড়ো রাখা। এদের কোনো কোনোটির ওজন ৫০০ কেজির কাছাকাছি। এদের বরং কুমড়ো না বলে মহাকুমড়ো বলা ভালো। চোখে না দেখলে এদের আকৃতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন!
দৃষ্টি কাড়ল এবার আরও দুই সঙ মানব। মনে হলো তারা দুহাত তুলে ডাকছে সবাইকে নিজেদের কুমড়োরাজ্যে। এবারের কুমড়োরাজ্যের বিশেষ আকর্ষণ হলো সার্কাসের দলের নানা পরিবেশনা। না না রক্ত–মাংসের মানুষের সার্কাস দল বলে আবার ভুল করবে না যেন। এরা সবাই কুমড়োমানব। কুমড়োর বাহারে যুক্ত হয়েছে নানা খেলা ও জাদুর ঝলক। পুরো কুমড়োরাজ্যে তাই সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। দলেবলে লোকজন এসে জড়ো হয়েছে তাই দেখতে। ১১টির বেশি সার্কাসের দৃশ্য একে একে কেড়ে নিল সবার মনোযোগ। বিশাল টুপির ভেতর থেকে জাদুর ছোঁয়ায় মাথা বের করে মিটিমিটি হাসছিল সাদা একটি খরগোশ। ওদিকে বানররাজ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে তার শখের বায়োস্কোপ নিয়ে। রঙিন ডিজিটাল পর্দায় ঝকঝকে ছবির যুগে মানুষজন আর বায়োস্কোপ দেখতে আসে না তাই তার চিন্তার কারণ। হেমন্তের শেষ সূর্যকিরণের মিষ্টি মায়ায় কুমড়ো স্যুপ আর পিঠা খেতে খেতে সবুজ ঘাসে বসে গান শুনছিলেন কেউ কেউ। তার খানিকটা দূরেই এগিয়ে আসছিল হাওয়ার বেগে তিনটি ঘোড়া। মাঝখানের ঘোড়ায় সওয়ার আবার নানা ভঙ্গিতে দেখাচ্ছিল তার ক্যারিশমা। কমলা জামার ওপর হালকা হলুদ রঙের কুমড়োর কোট পরে এক সঙ মানব এক শিশুর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে খেলা। কুমড়ো রঙের কমলা ফ্রক পরা থাকায় তাকে একদম আলাদা করা যাচ্ছিল না। এর প্রায় পাশেই তিন কুমড়োমানবের ঘাড়ে চড়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে ছিল দুই কুমড়োমানব। একদম নাড়াচাড়া ছাড়া। এখানেই শেষ নয়, ছিল হাতি–ঘোড়াও। এমনকি বাঘ মামা পর্যন্ত গোলাকার চাকতির ভেতর দিয়ে ঝাঁপ প্রায় দিয়েই দিচ্ছিল।
এসব দেখতে দেখতে হেমন্তের সোনালি রোদের ঝিলিক কমে আসছিল। সূর্য যখন চাইছে ছুটি, তখন কী আর করা। লাল, সবুজ, হলুদ, মেটে কুমড়োদের থেকে বিদায় নিলাম।