১০ টাকায় স্বাস্থ্যসেবা

টেকনাফের একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করছেন গুলফরাজ-হাশেম ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: ছুটির দিনে
টেকনাফের একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করছেন গুলফরাজ-হাশেম ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: ছুটির দিনে
৫ মার্চ প্রতিষ্ঠার ২০ বছর উদ্‌যাপন করেছে ফাউন্ডেশনটি। দুই দশকের পথচলায় এলাকার মানুষের কাছে আলোকিত প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকে বলেন, এটি ‘নাফ সীমান্তের বাতিঘর’।


বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে দুই ভাগ করেছে নীল নাফ নদী। এই নদীর পাড় ঘেঁষেই কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের মানুষের বসবাস। অধিকাংশই পেশায় জেলে কিংবা কৃষক। যাঁদের জীবনকে ছুঁয়ে যায়নি নাফ নদীর সৌন্দর্য।

প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের অসুখ-বিসুখে ছুটে যেতে হতো দূরের কক্সবাজার শহরে; উন্নত সেবা পেতে আরও দূরের চট্টগ্রাম নগরীর হাসপাতালে। কিন্তু এই যাত্রা বেশির ভাগ মানুষের জন্যই ছিল কঠিন, ব্যয়সাপেক্ষ। শুধু স্বাস্থ্যসেবার কথাই বলছি কেন, অভাবের কারণে গ্রামগুলোর ছেলে-মেয়ে মাঝপথে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। সীমান্তবর্তী বলে গ্রামের অনেক মানুষ জড়িয়ে পড়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য চোরাচালানে।

এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এলাকার কিছু অবস্থাসম্পন্ন মানুষ। ভাবেন, কিছু একটা করতে হবে। তাঁদেরই একজন হ্নীলা ফুলেরডেইল গ্রামের জামাল আহমেদ। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা। সবে তিনি এমবিবিএস পাস করেছেন। এলাকার মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য জামাল আহমেদ প্রতিষ্ঠা করেন একটি সেবামূলক ফাউন্ডেশন। মা গুলফরাজ আরা বেগম ও বাবা আবুল হাশেমের নামে সে ফাউন্ডেশনের নাম দিলেন ‘গুলফরাজ-হাশেম ফাউন্ডেশন’।

 গত ৫ মার্চ প্রতিষ্ঠার ২০ বছর উদ্‌যাপন করেছে ফাউন্ডেশনটি। দুই দশকের পথচলায় এলাকার মানুষের কাছে আলোকিত প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকে বলেন, এটি ‘নাফ সীমান্তের বাতিঘর’। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাতা জামাল আহমেদকে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে পুরস্কৃত করেছে।


স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক চক্কর

২১ মার্চ দুপুর ১২টা। ফুলেরডেইল গ্রামের ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে কিছু নারী ও শিশুর জটলা। তাঁদের একজন আসমা খাতুন এসেছেন আট কিলোমিটার দূরের ঝিমংখালী গ্রাম থেকে। ৩৪ বছর বয়সী এই নারী এসেছেন ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। ছয় মাস বয়সী মেয়ের সর্দি-জ্বর হয়েছে। এখানে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়।

দোতলা ভবনের নিচতলায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও জরুরি বিভাগ। পাশে অপারেশন থিয়েটার, বহির্বিভাগ ও চিকিৎসক বসার চারটি কক্ষ। আর দ্বিতীয় তলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের রোগী দেখার একটি কক্ষ, আরও দুটি কক্ষে কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও গণপাঠাগার।

স্থানীয় মানুষের ভরসার জায়গা গুলফরাজ-হাশেম ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্যকেন্দ্র
স্থানীয় মানুষের ভরসার জায়গা গুলফরাজ-হাশেম ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্যকেন্দ্র

জরুরি বিভাগে রোগী দেখছিলেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক জালাল উদ্দিন। ৪০ বছর বয়সী জালাল উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত এই কেন্দ্র খোলা থাকে। বর্তমানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত আছেন ২ জন এমবিবিএস চিকিৎসকসহ১০ জন স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁদের কাছে প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন রোগী স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসেন। যাঁদের বেশির ভাগ শ্বাসকষ্ট, সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু-কিশোর। সচ্ছল রোগীদের কাছ থেকে ১০ টাকা ফি নেওয়া হয়। ওষুধ বিতরণ হয় বিনা মূল্যে। তা ছাড়া প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এ কেন্দ্রে রোগী দেখেন চিকিৎসক এস এম রায়। তিনি ফি নেন ৫০ টাকা করে। তবে ওষুধ বিতরণ হয় বিনা মূল্যে। মাসে একবার রোগী দেখেন হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জামাল আহমেদ নিজেই।

জামাল উদ্দিন আহমেদ জানালেন, ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে ৬৮ হাজার ৭৭ জন মানুষ। উপজেলাভিত্তিক শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানের ৫৬৪ জন শিক্ষার্থী; এর বাইরে আরও ২২০ জন গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়েছে বৃত্তি। শুধু তা–ই নয়, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছে ৫০১ শিক্ষার্থী। ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম চালাতে প্রতিবছর যে খরচ হয়, তার বেশির ভাগ অর্থ জোগান দেন প্রতিষ্ঠাতা জামাল আহমেদ।

সবার জন্য পাঠাগার

ফাউন্ডেশন ভবনের দোতলার গণপাঠাগারে গিয়ে দেখা মিলল কয়েকজনের। যাঁদের কেউ দৈনিক পত্রিকা পড়ছেন, কারও দৃষ্টি বইয়ের পাতায়। গ্রন্থাগারিক এস এম সাইফ উল্লাহ বলেন, ‘মানুষের পাঠাভ্যাস খুব কম। দৈনিক গড়ে ৩০ জন পাঠক লাইব্রেরিতে আসেন বইপুস্তক পড়তে। আমরা চেষ্টা করছি বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে।’ পাঠাগারে বই আছে প্রায় চার হাজার। পাশেই কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র। সেখানে কম্পিউটার আছে আটটি। গ্রন্থাগারের আয়োজনে প্রতিবছর একজনকে ‘শ্রেষ্ঠ পাঠক’ নির্বাচন করা হয়। তেমনই একজন ফুলেরডেইল এলাকার হাসান মেহেরী। ২০১৫ সালের এই শ্রেষ্ঠ পাঠক বললেন, ‘এলাকায় জ্ঞানার্জনের তেমন কিছু নেই। তাই সময় পেলেই পাঠাগারে এসে পত্রপত্রিকা-বইপুস্তক পড়ি।’

জামাল আহমেদ
জামাল আহমেদ

জামাল আহমেদের স্বপ্ন
জামাল আহমেদ এখন চট্টগ্রাম নগরের বেসরকারি হাসপাতাল সেন্টার ফর স্পেশালাইজড কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ (সিএসসিআর) প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বললেন, ‘জনহিতকর কাজ বৃহত্তর আঙ্গিকে পরিচালনা করা কোনো এক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজন সাংগঠনিক ভিত্তি। আর তাই এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা। ২০ বছরে কতটা পেরেছি, তা এলাকার মানুষই ভালো বলতে পারবেন।’
জামাল আহমেদের স্বপ্ন এলাকায় একটি পরিপূর্ণ মাতৃমঙ্গল শিশু কল্যাণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। পাশাপাশি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে মসজিদভিত্তিক একটি করে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র ও গণপাঠাগার চালু করা। যেখানে দৈনিক পত্রিকা, বইপুস্তক পাঠের পাশাপাশি তৃণমূলের দরিদ্র লোকজন বহুমুখী স্বাস্থ্যসেবা পাবেন।