‘রক্তস্নান’ চেয়েছিলেন কিসিঞ্জার?
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন কূটনীতির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। যুক্তরাষ্ট্রের লেখক, বুদ্ধিজীবী, জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান ছিল বিপরীত। মার্কিন দলিল থেকেই একাত্তরের মার্চের একটি অজানা অধ্যায় ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ তুলে এনেছিলেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। ২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর লেখাটি আবার প্রকাশ করা হয়।
প্রথম আলোর সংগ্রহ করা মার্কিন দলিল একাত্তরের গণহত্যায় হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকাকে নতুন করে নির্দিষ্টভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। লেখাটি প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের লেখক, বুদ্ধিজীবী, জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান ছিল বিপরীত। মার্কিন দলিল থেকেই একাত্তরের মার্চের একটি অজানা অধ্যায় এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রথম আলোর সংগ্রহ করা একটি মার্কিন দলিল একাত্তরের গণহত্যায় হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকাকে নতুন করে নির্দিষ্টভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতি হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত সমর্থনের সপক্ষে একাত্তরের ৬ মার্চে প্রস্তুত এই দলিলটিকে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ তিনি সুপরিকল্পিতভাবে ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য রক্তস্নান নীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি এমনকি বলেছিলেন, ‘আমাকে শয়তানের পক্ষে ওকালতি (ডেভিলস অ্যাডভোকেট) করতে দাও।’
২০০১ সালে মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচিন্স তাঁর দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার জন্য কিসিঞ্জারের বিচার দাবি করেন।
এখন ওই মার্কিন দলিলই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সামরিক অভিযানকে নিরুৎসাহিত করাকে তিনি মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মনে করেননি। অথচ বাংলাদেশ-সংকটে ভারতের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপকে নিবৃত্ত করার বিষয়ে তিনি এদিনই পাকা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।
জেনারেল ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য ‘রক্তস্নান’ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরামর্শ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা কেবল প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত থাকেননি। কিসিঞ্জার এ বৈঠকে উল্টো প্রশ্ন তুলেছিলেন যে ইয়াহিয়া রক্তস্নান নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন তার বিরোধিতা করতে হবে? কিসিঞ্জার এ প্রসঙ্গে অকপটে রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সঙ্গে ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত সম্পর্কের দোহাই দিয়েছিলেন।
একাত্তরের ৬ মার্চ সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের সভায় তিনবার রক্তস্নান ও একবার রক্তপাত কথাটি উচ্চারিত হয়। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মার্কিনরা কী করবে, তা ঠিক করতেই ওই বৈঠক বসেছিল।
মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলোর সংগ্রহ করা ওই দলিল এবং একই দিনের বৈঠকের কার্যবিবরণী, যা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০০১ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অনলাইনে প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে কিসিঞ্জারের মন্তব্যে কিছুটা তাৎপর্যপূর্ণ অমিল লক্ষ করা গেছে। অবশ্য বৈঠক একই হলেও মূল নথি থেকে এই প্রতিবেদকের স্ক্যান করা অনুলিপিটি হলো ওই একই বৈঠকের ‘নোটস’। আর অনলাইনে রয়েছে বৈঠকের পূর্ণ কার্যবিবরণী।
নোটসে লেখা, রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ইউ অ্যালেক্সিস জনসন বলেন, ‘পাকিস্তান শক্তি প্রয়োগ করলে আমাদের তা নিরুৎসাহিত করা উচিত হবে বলে আমি মনে করি। উত্তরে কিসিঞ্জার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর বিরোধিতা করে বলেন, ‘‘কেন? আমাকে শয়তানের পক্ষে ওকালতি করতে দাও। আমাদের কেন কোনো কিছু বলতেই হবে?’’’
এই একই বাক্য ঈষৎ পরিবর্তিত রূপে অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে। এবং এর ফলে হেনরি কিসিঞ্জারের দায় কিছুটা হলেও লঘু হয়েছে। জনসনের ওই একই প্রশ্নের উত্তরে কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমি যদি শয়তানের পক্ষে ওকালতি করি, তাহলে আমাদের কেন কিছু বলতেই হবে?’ লক্ষণীয় তিনটি বাক্যকে একটি বাক্যে পরিণত করা হয়েছে। তদুপরি নোটস ও অনলাইনে প্রকাশিত মিনিটস মিলিয়ে পড়লে পরিষ্কার ফুটে ওঠে যে হেনরি কিসিঞ্জার গণহত্যার বিষয়ে নীরবতা পালনের জন্য আগেভাগেই মনঃস্থির করেছিলেন। এবং তিনি তাঁর সহকর্মীদেরও তাঁর দলে ভেড়াতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। যদিও কিসিঞ্জার ৬ মার্চের বৈঠকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অন্যদের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন যে একটি রক্তস্নান ঘটবে। কিন্তু ইয়াহিয়া তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না। অ্যালেক্স জনসন বলেছিলেন, সে ক্ষেত্রে মার্কিন স্বার্থ হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই রক্তস্নান থামিয়ে দেওয়া।’
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন। ৬ মার্চের ওই বৈঠকের নোটসে আছে, তিনি বলেছিলেন, ‘যদি একটি রক্তস্নান অব্যাহত থাকে, তাহলে আমরা হয়তো হস্তক্ষেপ করার মতো বিকল্প বিবেচনা করতে পারি।’ এর পরই কিসিঞ্জারের বরাতে শেষ বাক্য এবং সেটি দাগ টানা ‘মুজিবের ভাষণের পরে আমরা আবারও কথা বলে নেব। তবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নয়!’
উল্লেখ্য যে ভ্যান হোলেন বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত। তাঁর ছেলে ডেমোক্র্যাট দলীয় ক্রিস ভ্যান হোলেন ম্যারিল্যান্ড থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসম্যান। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের অন্যতম সদস্য। গত মার্কিন নির্বাচনকালে ওয়াশিংটনে প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতেই বাবার বাংলাদেশ অনুরাগ স্মরণ করেন তিনি।
ভ্যান হোলেন একাত্তরের ৬ মার্চে কিসিঞ্জারকে আরও বলেছিলেন, সামরিক বাহিনীর অযৌক্তিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। আর তখনই তাঁকে কিসিঞ্জারের দক্ষিণ হস্ত হিসেবে পরিচিত হ্যারল্ড স্যান্ডার্স বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, ইয়াহিয়া বলেছেন যে তিনি পাকিস্তানের ভাঙনে পৌরহিত্য করতে চান না।’
ভ্যান হোলেন ১৯৮০ সালে তাঁর লেখা এক নিবন্ধে বলেন যে ইয়াহিয়ার প্রতি নিক্সনের ‘দ্য টিল্ট’ বা ঝুঁকে পড়া নীতি ২৫ মার্চের আগ থেকেই বলবৎ ছিল। আরও লক্ষণীয়, ভ্যান হোলেন, যিনি ওই ৬ মার্চের ওই সভার অন্যতম অংশগ্রহণকারী, তিনি তাঁর ওই নিবন্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের কণ্ঠে তিনি যে নিক্সন-ইয়াহিয়ার ‘বিশেষ সম্পর্কের’ কথা শুনেছিলেন, সে তথ্যও প্রকাশ করেছিলেন।
মনে হচ্ছে, ওই সভায় মুজিবের প্রতি সহানুভূতিশীলদের প্রতি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আমরা কী করতে পারি? আমরা কি বলতে যাব নাকি যে ইয়াহিয়া যা এখন করছেন, আমরা তা সমর্থন করি না?’ এ রকম একগুঁয়ে মন্তব্যের পরও জনসন বলেছিলেন, আমরা সামনে পড়ব না। ব্রিটিশদের থাকতে বলব। কিসিঞ্জার এতেও আগ্রহ দেখাননি। বরং প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে সহকর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে ইয়াহিয়ার ‘সম্পর্ক’ রয়েছে। দুটি নথিতেই কিন্তু বিশেষ সম্পর্ক কথাটি নেই। ভ্যান হোলেন বলেছেন বিশেষ সম্পর্ক। কিসিঞ্জার ৬ মার্চের সভায় আরও বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা (রক্তস্নান প্রসঙ্গে) বলতে আগ্রহী হবেন না। আমাদের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইয়াহিয়ার সম্পর্ক অবশ্যই সুরক্ষা দিতে হবে এবং আমাদের হস্তক্ষেপ করা হবে অবিজ্ঞচিত।’
উল্লেখ্য যে কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে নিক্সনকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ইয়াহিয়াকে এখন রক্তপাত বন্ধ করতে বলা হয়তো আগাম বলা হবে। এ বিষয়ে আজ অনুষ্ঠেয় এক সভায় কী সুপারিশ করা যায়, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু কিসিঞ্জার কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। ২৬ মার্চ বেলা তিনটা তিন মিনিট থেকে তিনটা ৩২ মিনিট পর্যন্ত ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক হয়। পররাষ্ট্র দপ্তর, প্রতিরক্ষা, সিআইএ প্রভৃতি সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা অংশ নেন।
‘‘কিসিঞ্জার: আগামী কয়েক দিনের পূর্বাভাস কী?
জনসন: ঢাকায় ভোর হয় আমাদের রাত সাতটা বা আটটায়। এক দিন পরেই জানতে পারব কতটা রক্তপাত সেখানে ঘটেছে।
কিসিঞ্জার: যদি দরকার পড়ে, তাহলে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে আনা ছাড়া সেখানে আমাদের কিছুই করণীয় নেই।’’
সুতরাং প্রশ্ন দাঁড়ায়, কিসিঞ্জার কী করে একাত্তরের রক্তস্নানের দায় এড়াতে পারেন? তিনি তো রক্তস্নান চেয়েছিলেন!
মিজানুর রহমান খান সাংবাদিক
ই–মেইল: [email protected]