বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে লালনশিল্পী ফরিদা পারভীনের বক্তব্য বেশ বিতর্ক ও উত্তাপের জন্ম দিয়েছে। ফরিদা পারভীন দাবি করেছেন যে শাহ আবদুল করিম আদতে কোনো বাউলই ছিলেন না। পাল্টা বক্তব্যে বাউলশিল্পী আবদুল কুদ্দুছ বয়াতি খারিজ করে দিলেন শিল্পী ফরিদা পারভীনকে। এই খারিজীকরণ চলছে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে, কয়েক দিন ধরে। কিন্তু এটা মোটেও কয়েক দিনের মামলা নয়। বিভিন্ন আকারে ও প্রকারে এই রেষারেষি চলমান আছে প্রায় এক শ বছর ধরে, আরও থাকবে এ রকম আশঙ্কাও করা যায়। ফলে এই বিতর্ককে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা অত্যন্ত জরুরি। ফরিদা পারভীনের দাবির একটা ভিত্তি অবশ্যই আছে। আভিধানিক অর্থে বাউল বলতে যা বোঝায়, শাহ আবদুল করিম তা ছিলেন না। তিনি মূলত সংগীতকার ছিলেন। গান বাউলিয়ানার একটা অংশমাত্র, সমগ্র বাউলিয়ানা নয়। বাউল গানের চর্চার বাইরে তিনি বাউলধর্মের অপরাপর বিষয়-আশয়ের চর্চা নিজের জীবনে করেছেন, এমনটা জানা যায়নি। কিন্তু ফরিদা পারভীনের দাবির ভিত্তি উদ্ঘাটন করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তিনি নিজেও ছেঁউড়িয়ার বাউল নন, লালনগীতির শিল্পীমাত্র। একই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছেন, নজরুলসংগীত কিংবা আধুনিক গান গেয়ে ফিরোজা বেগম কিংবা ফেরদৌসী রহমানের ছায়ায় পড়ে থাকার চেয়ে তিনি লালনগীতি গেয়ে বিশিষ্ট হওয়ারই আরাধনা করেছেন। ফলে এটি পরিষ্কার যে কোনো আধ্যাত্মিক পরিক্রমার অংশ হিসেবে তিনি লালন বাছাই করেননি। এহেন প্রেক্ষাপট নিয়ে মূলধারার শিল্পী ফরিদা পারভীন কেন আবদুল করিমের বাউল হওয়া না-হওয়া নিয়ে এমন সিদ্ধান্তময় হয়ে উঠলেন? ফরিদা পারভীনের জীবনে, বিশ্বাসে বা পেশাগত পরিক্রমায় আবদুল করিমের বাউল হওয়া না-হওয়া কেন এত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠল? বিষয়টা খোলাসা করতে গেলে একটু পেছন থেকে আলাপটা শুরু করতে হবে। লালনের গান নিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথের তৎপরতার কথা জানি। লালন তথা বাউলসংগীত দিয়ে তিনি নিজেও কী বিপুল পরিমাণ প্রভাবিত হয়েছেন, সে খবরও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু সুধীর চক্রবর্তী আমাদের জানান যে রবীন্দ্র তৎপরতারও আগে লালনের জীবদ্দশায় লালনের গান অনুকরণের প্রবণতা শুরু হয়েছিল। একদল গায়কের কথা তিনি বলেছেন, যাঁরা লালনের অনুকরণে গান লিখে লালনের জীবদ্দশাতেই প্রভূত সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁরা কিন্তু নেহাত শিল্পীই ছিলেন, বাউলধর্মের অপরাপর আচার-অনুষ্ঠান মানতেন না। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ যখন বাউলকে বিশ্বদরবারে পেশ করেন, তখন তাঁকে তিনি যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধমুক্ত করেই পেশ করেন বলে জানিয়েছেন হিউগ আরবানসহ অনেকে। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই বলেন, গানই বাউলদের আরাধনার একমাত্র পদ্ধতি। অথচ এমন নয় যে রবীন্দ্রনাথ বাউলদের আরাধনার অপরাপর আচার-বিচার সম্পর্কে জানতেন না। সামাজিক শুচিবাই, নাকি সমকালীন বাউলবিদ্বেষকে মোকাবিলা—ঠিক কোন উদ্দেশ্যে তিনি এই ‘শুদ্ধি’ অভিযান চালিয়েছিলেন, তা আজ বোঝার উপায় নেই। এতে কাজের কাজ যেটা হলো, শিক্ষিত বিত্তবানের কাছে লালন বা বাউল কেবলই গান হয়ে উঠল। ক্রমে জাতি গঠনের নানা রকম পরিক্রমায় লালনকে আমরা আইকনরূপে ভেবে নিতে থাকলাম। এমনকি নজরুল ইনস্টিটিউট হওয়ারও প্রায় অর্ধযুগ আগে স্বাধীন বাংলাদেশে লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই একাডেমিও বাউল গানের একাডেমি, বাউলধর্মের নয়। এই ইতিহাসটুকু পাড়লাম এটা বলতে যে গানকে অপরাপর বাউল আচার থেকে আলাদা করে ভজনা করার প্রবণতা কেবল শিক্ষিত বাঙালিরই ছিল না, অবাউল গ্রামীণ গোষ্ঠীর মধ্যেও ছিল। ১৯৭২ সালে মিরপুরের শাহ আলীর মাজার ঘেঁষে ছাপরাঘর তুলে যারা ‘বাউল শিল্পী ফেডারেশন’ বানিয়েছিলেন, তাঁদেরও অনেকে বাউলদের সব আচার মানতেন, এমন বলা যাবে না। ‘বাউল’ আর ‘বাউলশিল্পী’র মধ্যে যে মৌলিক ভেদ আছে, এ কথা তাঁরাও বলেন, কিন্তু তার পরও নিজেদের ‘বাউল’ মনে করেন। ছেঁউড়িয়ার বাউলদের সঙ্গে তাঁদের ওঠাবসা নেই, সামনাসামনি হলে একে অপরের নিন্দামন্দ করতেও ছাড়েন না। কিন্তু এ-ও বিলক্ষণ জানেন যে বাউলবিরোধী মোল্লাতন্ত্র তাঁদের কোনো দলকেই রেহাই দেয় না। জীবনচর্চায় বাউল না হয়েও বাউলশিল্পীরা সমান নিগ্রহের শিকার। যেসব আচার-আচরণ, রীতি-পদ্ধতি নিয়ে একটা ক্লোজড ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বাউলধর্ম বিকশিত হয়েছিল লালনের হাত ধরে, তার অবিকল অনুবর্তনের মাধ্যমে নিশ্চয় বাউলধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়। সেই চেষ্টায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু এর বাইরে যে বিপুল পরিমাণ প্রাণশক্তি ও সৃজনশীলতা দশকের পর দশক ধরে বাউলগানের ফর্মের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের বিচিত্রভাবে প্রকাশ করে চলেছে, তাকে স্রেফ ভাঁওতাবাজি বা বাণিজ্যিক মনে করা আরেক ধরনের মৌলবাদ। বেশ কিছু কাল ধরে আমরা দেখছি কীভাবে এই শিল্পীরা—শাহ আবদুল করিম, আলাউদ্দীন বয়াতি, আবদুর রহমান বয়াতি, কাঙালিনী সুফিয়া, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, আবুল সরকার, শাহ আলম সরকারসহ আরও অনেকে নীরবে-নিভৃতে বাংলা গানের চেহারা পাল্টে দিচ্ছেন। বিপুলসংখ্যক শ্রোতাগোষ্ঠীকেও তাঁরা হাজির করেছেন সংগীত ইন্ডাস্ট্রির দরবারে। তাঁদের ‘অবাউল’ আখ্যা দিয়ে কোন প্রান্তীয় সীমায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? তাঁরাও বাউলশিল্পী, লালন তাঁদেরও আরাধ্য এবং হাতিয়ারও। জীবনচর্চায় বাউল নন—এ অভিযোগ তুলে তাঁদের গান ও সাধনাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কোনো অবস্থা নেই আর। ফরিদা পারভীন যখন বলেন যে আবদুল করিম বাউলই নন, তখন তাঁর মানসচক্ষে নিশ্চয়ই আরেকটা শান্তিনিকেতন ভাসে, যেখান থেকে তাঁর কিংবা তাঁর শ্রেণীর কারও তত্ত্বাবধানে অথেনটিক বাউলিয়ানার ছাড়পত্র দেওয়া হবে! এমনটাই ভাবা হচ্ছিল এক দশক আগেও। কিন্তু মানুষ যখন থেকে আবদুল করিমসহ অপরাপর বয়াতিকে আবিষ্কার করতে শুরু করল, তখন থেকেই বাউল প্রতিষ্ঠানের চেহারা খানিক ভিন্ন হয়ে উঠল। এ সময়ে লালন একদিকে যেমন প্রাচীরঘেরা জীবনাচারের নাম, অন্যদিকে লালন শ্রেণীবিনাশী একটা বহমান নদীও। বাউল যেমন সুস্পষ্টভাবে আছে এটা সত্য, তেমনি বাউল প্রতিদিন হয়ে উঠছে, এটাও সমান শক্তিশালী সত্য। এ দুই সত্যকে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বী আকারে দেখেন, যাঁরা একটা দিয়ে অন্যটিকে খারিজ করে দিতে চান, তাঁরা আগে নিজের দিকে তাকান। বাংলা গানের খই কিংবা বাউলিয়ানার চিড়া কোনোটাই তাঁদের মিষ্টি কথায় ভিজবে বলে মনে হয় না।
সুমন রহমান: লেখক। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে শিক্ষকতা করেন।