১৯৭১ সালের বিজয় দিবস দেখেছি। আমার দেখা অবিস্মরণীয় দিন ছিল সেটি। জনতার উল্লাস-মুক্তিযোদ্ধা-মিত্রবাহিনীর শহরে প্রবেশ-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ-শহরজুড়ে লাল-সবুজ পতাকার উড্ডয়ন মিলিয়ে দুঃখ-বেদনা-আনন্দ-গৌরব ছিল সেই বিজয় দিবসে। রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ করছিলেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল আজানের ধ্বনি।
এ কথা এক গভীরতম সত্য যে এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তারা বুঝতে চায় না ইসলাম শান্তির ধর্ম। সহিংসতার ধর্ম নয়। তাদের হঠকারিতার কারণে তারা রাজনীতির নামে ধর্মের মৌল সত্যকে অস্বীকার করেছে। তাই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কখনোই ভোটে বিজয়ী হতে পারেনি এই দল।
২০১৩ সালের বিজয়ের মাস বাঙালির জীবনে আবার গভীর তাৎপর্য নিয়ে ফিরে এসেছে। বাঙালি তার অসমাপ্ত কাজের কিছু অংশ সম্পন্ন করতে পেরেছে। এই বিজয়ের মাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতের নেতা যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বিজয়ের মাসে এটি আরেকটি অবিস্মরণীয় দিন।
যে যুদ্ধাপরাধীরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, তাদের শাস্তি পেতেই হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে এক হতে হবে। শক্ত অবস্থান তৈরি করে জঙ্গিবাদের উত্থান বন্ধ করতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সবার স্বপ্নের বাংলাদেশ যেন গৌরবের জায়গা থেকে দূরে সরে না যায়।
এই বিজয়ের মাসে মানুষের বুকফাটা আর্তনাদে তলিয়ে গেছে স্বদেশ। পুড়ে দগ্ধ হওয়া মানুষেরা একাত্তরের পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের সমতুল্য যন্ত্রণা ভোগ করেছে। হত্যা-নির্যাতন-জাতীয় সম্পদ ধ্বংস-বৃক্ষনিধন, যানবাহনে আগুন, ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, গ্রেনেড, পেট্রলবোমার ব্যবহার ইত্যাদি করে জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি মানুষকে একাত্তরে তাদের অবস্থান আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হয়েও সেদিন তারা জিততে পারেনি, আজও পারবে না। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চেও তরুণ প্রজন্মের সমাবেশ এই সত্যকে প্রতীয়মান করে। তারা বলছে, রাজাকারমুক্ত করবে স্বদেশ।
যে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন-সহযোগিতা না দিয়ে হানাদার বাহিনী পাকিস্তানিদের সহযোগিতা দিয়েছিল, ৪২ বছর পরও তারা ভোলেনি সেই সব স্বাধীনতাবিরোধীদের। আপনজন তখন ছিলেন নিক্সন-কিসিঞ্জার, এখন আছেন ওবামা-জন কেরি। সে জন্য কাদের মোল্লার প্রাণরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। যে ভুল করেছিলেন একাত্তরে, তার জন্য অনুতপ্ত হন না। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে তাকিয়ে তাঁদের বোঝা উচিত ছিল তরুণ প্রজন্ম কী চায়। সময়ের নাড়ি অনুধাবন না করে তাঁরা আবার নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভূমিকা পালন করছেন।
এটা সত্যি যে একাত্তরে যেমন তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, ২০১৩-তেও তাদের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হয়েছে। অনেক দুঃখ-বেদনা-মৃত্যুর যন্ত্রণার মধ্যে এটা সান্ত্বনা। সামনে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হবে, ‘সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান আগে।’
বাংলাদেশের বিজয়ের মাসে মৃত্যুবরণ করলেন বিশ্ববিবেক নন্দিত রাজনীতিবিদ-রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসবে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশ আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। যে প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি ভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তার ন্যূনতম মানবিক আবেগ মার্কিন রাষ্ট্রনায়কদের ছিল না।
৪২ বছর পরে দেশ অনেক এগিয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছে এ দেশের মানুষ। একাত্তরের খুনির মানবাধিকার কী করে ভিন্ন দেশের মানুষের কাছে বড় হয়, এটা অবিশ্বাস্য লাগে।
ম্যান্ডেলার রাজনীতির দর্শনে শান্তি ও গণতন্ত্র শব্দ দুটো অটল ছিল। তিনি প্রতিরোধ ও সমঝোতার বিষয়কে গভীরভাবে দেখেছিলেন। আজকের বাংলাদেশে এ সত্যটি দেখার সময় হয়েছে। রাজনীতি যেন মানুষের পক্ষেই থাকে সত্য উপলব্ধির ভেতর দিয়ে। মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে দাঁড়িয়ে কোনো নারী যেন কাঁদতে কাঁদতে না বলেন যে গণতন্ত্রকে লাথি মারি।
আমরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই। একজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়াই শেষ কথা নয়। আমরা সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর দেখতে চাই। আমরা শান্তি ও স্বস্তির দেশ দেখতে চাই। বাংলাদেশ একটি ধর্মের দেশ নয়, সব ধর্মের, জাতি-বৈচিত্র্যের দেশ, এটা বড় গলায় বলার উৎসব চাই। যারা সহিংস রাজনীতি নিয়ে মানুষের জীবন ছারখার করছে, তাদের শক্ত হাতে দমন করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই। বিজয়ে
মানুষ আনন্দ করবে, সেই পরিসর উন্মুক্ত করার জন্য বিরোধী দলকে অনুরোধ জানাই।
২০১৩ সালের বিজয়ের মাস দেশের মানুষের মর্যাদার বোধকে সমুন্নত করেছে—২০১৩ সালের বিজয়ের মাস তরুণ প্রজন্মকে প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ করেছে—এই হোক আমার শান্তি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই—‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।’
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক।