৭৩ বছরের ক্ষত ও নাগাসাকির মেয়র
তোমোহিসা তাউয়ে জাপানের আণবিক বোমা হামলায় বিধ্বস্ত দ্বিতীয় শহর নাগাসাকির মেয়র। নাগাসাকির পর বিশ্বের অন্য আর কোনো শহরকে যেন পরমাণু হামলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়, সেই লক্ষ্য অর্জনে অনেক দিন থেকেই তিনি কাজ করছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হিবাকুশা নামে পরিচিত আণবিক বোমা হামলার সরাসরি শিকার হতে হওয়া প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পেতে থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সেই বার্তা বিশ্বের সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পৌঁছে দেওয়ার নতুন উপায় খুঁজে দেখায় তাঁর প্রশাসন এখন সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত আছে। স্মৃতি ধরে রেখে নতুন প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দিয়ে বিশ্বকে ঝুঁকিমুক্ত করার নানা রকম উদ্যোগ হিরোশিমার পাশাপাশি নাগাসাকিতেও হাতে নেওয়া হচ্ছে। বোমা হামলার ৭৩তম বার্ষিকী এগিয়ে আসার মুখে নাগাসাকি শহরে নিজ কার্যালয়ে জাপানে কর্মরত কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। নাগাসাকির সাম্প্রতিক কিছু অগ্রগতির বর্ণনা তুলে ধরার পাশাপাশি প্রশ্নোত্তর পর্বে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্য অর্জনে জাপানের করণীয় এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পথে পূর্ব এশিয়ায় দেখা দেওয়া সাম্প্রতিক কিছু সম্ভাবনা নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর সেখানে তিনি দেন।
গত বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নাগাসাকির জন্য বিশেষ আনন্দদায়ক ছিল উল্লেখ করে শুরুতেই মেয়র তাউয়ে বলেছেন, জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক কাজুও ইশিগুরোর হাতে নাগাসাকি শহরের নাগরিকত্বের সনদ তুলে দেওয়ার জন্য কিছুদিন আগে তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে ইশিগুরোর সাক্ষাৎ লাভ তাঁর জন্য ছিল তৃপ্তিদায়ক এক অভিজ্ঞতা। ইশিগুরোর পৈতৃক নিবাস একসময় ছিল নাগাসাকি শহরে এবং শৈশবে বাবা-মায়ের সঙ্গে বিলেতে চলে যাওয়ার আগে সেখানে তিনি স্কুলের লেখাপড়া শুরু করেছিলেন। সেই সূত্রে নাগাসাকি এখনো তাঁকে নিজের সন্তান হিসেবে গণ্য করে।
পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পথে উত্তর কোরিয়া নিয়ে দেখা দেওয়া সাম্প্রতিক কিছু সম্ভাবনার ইঙ্গিতকে নাগাসাকি ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করে মেয়র তাউয়ে বলেছেন, লক্ষ্য অর্জনের পথে যেসব বাধাবিপত্তি এখনো রয়ে গেছে, সেগুলো অবশ্যই দূর করে নিতে হবে এবং তা করতে হলে চূড়ান্ত লক্ষ্য কী হবে, তা নিয়ে সব পক্ষের পরিষ্কার বোধগম্যতা থাকা উচিত। দুই কোরিয়ার যৌথ ঘোষণা এবং যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া ঘোষণায় পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের উল্লেখ থাকাকে নাগাসাকি ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছে। নাগাসাকির মেয়র আরও উল্লেখ করেছেন, উত্তর-পূর্ব এশিয়াকে পরমাণুমুক্ত অঞ্চল ঘোষণার লক্ষ্যে নগর প্রশাসন বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করে চলেছে। নাগাসাকি নগর সরকারের সহযোগিতায় নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্ত গবেষণা কেন্দ্র রেকনার সঙ্গে যুক্ত গবেষকেরা ২০১৫ সালে আণবিক বোমা হামলার ৭০তম বার্ষিকীতে উত্তর-পূর্ব এশিয়াকে পরমাণুমুক্ত অঞ্চল ঘোষণার ধারণাকে সামনে রেখে বিস্তৃত যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, লক্ষ্য অর্জনের পরিষ্কার কিছু দিকনির্দেশনা সেখানে দেওয়া হয়েছে।
মেয়র তাউয়ে আরও উল্লেখ করেন, উত্তর-পূর্ব এশিয়াকে পরমাণুমুক্ত অঞ্চল ঘোষণার ধারণা বাস্তবায়িত হলে জাপানকে হয়তো মার্কিন পরমাণু ছত্রচ্ছায়া থকে বের হয়ে আসতে হবে এবং তাঁর বিশ্বাস, অঞ্চলজুড়ে মোতায়েন মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তাও তখন হয়তো শেষ হবে। তবে তেমন কিছু ঘটার আগে দুই কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাপানের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনকেও সম্পৃক্ত হতে হবে।
নাগাসাকির মেয়র বলেছেন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, পরমাণু অস্ত্রের সার্বিক বিলুপ্তি কেবল সম্ভবই নয়, বরং ভয়াবহ এক পরিণতির হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে হলে সেই লক্ষ্য অর্জন অবশ্যই উচিত। পরমাণু অস্ত্রের মালিকানা যত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের হাতে থাকবে, এসব অস্ত্র যে বাস্তব অর্থে ব্যবহার করা হবে না, তত দিন পর্যন্ত তার কোনো নিশ্চিত গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে সে রকম অস্ত্রের সার্বিক বিলুপ্তি হচ্ছে পরমাণু হামলার ভয়াবহ পরিণতির হাত থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার সবচেয়ে যৌক্তিক উপায়। সেদিক থেকে নাগাসাকি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের সব রকম উদ্যোগকে স্বাগত জানায় উল্লেখ করে মেয়র তাউয়ে বলেছেন, পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির জাতিসংঘ চুক্তিতে জাপানের যোগ না দেওয়া তাঁকে হতাশ করেছে। জাপানের ৩০০টির বেশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান চুক্তিতে যোগ দেওয়ার জন্য জাপানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উত্তর-পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকা জাপানের জন্য চুক্তিতে যোগ দেওয়ার পথ করে দিতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী। সেদিক থেকে দুই কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ বৈঠকের ফলাফলের ইতিবাচক মূল্যায়ন তিনি করে থাকেন।
জাপানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির সামর্থ্য নিয়ে যেসব প্রশ্ন সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে উত্থাপিত হচ্ছে, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে মেয়র তাউয়ে বলেছেন, সে রকম উদ্বেগের পেছনের প্রধান কারণ হচ্ছে জাপানের মজুত প্লুটোনিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে ২০১১ সালের ফুকুশিমা পরমাণু দুর্ঘটনার পর দেশের অধিকাংশ পরমাণু চুল্লি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অব্যবহৃত প্লুটোনিয়ামের মজুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে পরিমাণ প্লুটোনিয়াম এখন জাপানের কাছে আছে, সেগুলো কাজে লাগিয়ে ছয় হাজারের বেশি আণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব উল্লেখ করে নাগাসাকির মেয়র বলেছেন, সেই উদ্বেগ হ্রাসে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সংবাদ সম্মেলনের শেষে প্রথম আলোর জাপান প্রতিনিধি প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিত হিরোশিমা-নাগাসাকির ওপর লেখা তাঁর সাম্প্রতিক বইয়ের একটি কপি নাগাসাকির মেয়রের হাতে তুলে দেন। বইয়ের প্রচ্ছদে নাগাসাকি শহরের আণবিক বোমা জাদুঘরের সামনে স্থাপিত একটি ভাস্কর্যের ছবি ব্যবহৃত হওয়ায় মেয়র লেখক ও প্রথমা প্রকাশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, জাপানি ভাষায় সেটা অনুবাদ করে নেওয়া যায় কি না, তা তিনি ভেবে দেখবেন। (সমাপ্ত)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
আগের দুই পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন:
প্রথম পর্ব: আণবিক বোমা হামলা ও হিরোশিমার সাহসী চিকিৎসাকর্মীরা
দ্বিতীয় পর্ব: বোমা হামলার স্মৃতি ও নাগাসাকির শিরোইয়ামা প্রাইমারি স্কুল