কার্তিক মাসে হিম ঝরার শুরুতেই লালমুখো কালো রাজহাঁস সাগর পেরিয়ে সুন্দরবনের নলখাগড়া ও হোগলার ঝোপে বাসা বাঁধে। ডিম পেড়ে বাচ্চা তোলে। নদী-খালের শামুক, ছোট মাছ খাইয়ে বাচ্চাদের বড় করে মাঘের শেষে উড়ে যায়। হেমন্তের রোদেলা আকাশে শামুক খোল, আর মানিকজোড় গলা তুলে ভেসে বেড়ায় দ্বীপের খাঁড়ির মুখে। বাংলাদেশের তালপুকুর আর হাওর-বিলে ছাওয়া গ্রামের ঝোপড়া গাছে সাদা বক আর কালো পানকৌড়ির ঝাঁক নামে বছরের এ সময়টাতে। গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে এই পাখিদের আশ্রয় দেয়, চোরাগোপ্তা হামলা থেকে রক্ষা করে। আশপাশের পাখিরা, কেমন করে জানি না, পেয়ে যায় এমন অভয় আশ্রয়ের খোঁজ। পরের বছর আরও বক-পানকৌড়ি হাজির হয় এসব গ্রামে। বাসা বাঁধে, বাচ্চা মানুষ করে। সন্দেহ নেই প্রকৃতি নিয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বেড়েছে।
গ্রামীণ মেলা-পার্বণের মৌসুম শুরু হয় এ সময়েই। হেমন্তে ধান কাটা হয়ে গেলে গ্রামের মানুষের প্রচুর আসর জোটে; কিছু পয়সাও হাতে থাকে। এ সময় নানা ধরনের রঙিন মেলা বসে গ্রামের মাঠে। কোনো ধর্মীয় উপলক্ষ নিয়ে, আবার অনেকগুলোই নেহাত কেনাবেচার মেলা, সেই সঙ্গে কিছু গানবাজনা। নাগরদোলা আর হরেক রকম তামাশা। এসব মেলার একটা বড় বৈশিষ্ট্য এখানে জাত-ধর্মের ভেদ কম।
গ্রামীণ গায়ক-বাদকদের চর্চা ও পরিচিতি এই সব মেলার মাধ্যমেই হয়েছে একসময়। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর ছেলেবেলায় মেলায় গ্রামীণ গায়কের গলায় শোনা একটি গানের কথা লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। গানের কথাগুলো এ রকম:
‘...পরের জন্য কান্দে আমার মন/ আমি পর করে পরকাল হারাইলাম/ আমার সেই পরে দেয় জ্বালাতন/...’
সহজ ভাষা, সরল সুর অপূর্ব মনকাড়া এই গান পরবর্তী সময়ে শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গলায় রেকর্ড হয়েছিল।
আমাদের যাত্রাদলগুলো বছরভর এসব দিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। গঞ্জের বাজারে প্যান্ডেল বেঁধে যাত্রা দেখিয়ে আয় নেহাত মন্দ নয়। এই রোজগার দিয়েই বাকি বছর দলের খরচ টানতে হবে। সুখের বিষয়, ডিভিডি/ছায়াছবির দাপট সত্ত্বেও গ্রামে নারী-পুরুষ, ছেলে-ছোকরারা এখনো যাত্রা দেখতে সমান আগ্রহী। রাতের খাওয়া সেরে, গায়ে চাদর মুড়ো দিয়ে তারা যাত্রার আসরে ভিড় করে। বাড়ি ফেরে ভোরে। ঐতিহাসিক আর সামাজিক পালার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পালা বা দেশপ্রেমকে উপজীব্য করে লেখা পালা মানুষকে টানে প্রবল আকর্ষণে। সেসব পালার কত নাম—‘সোনার বাংলা,’ ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘সিরাজদৌলা’, এই ভরা মৌসুমে যাত্রা কোম্পানিগুলোর অবসর নেই পুরো শীত মৌসুম ধরে। ঘুরে ঘুরে পালা দেখিয়ে ঘরে ফিরবে সেই মাঘের শেষে।
অগ্রহায়ণ মাসে জমায়েত হয় দূর-দূরান্ত থেকে আসা নানা মারফতি-ফকিরের দল। গায়ে তাদের নানা রঙের ঢিলে পাঞ্জাবি, হাতে বাঁশের লাঠি, কারও হাতে সারিন্দা। নতুন ধানের খড় বিছানো উঠানে বসে সারা রাত চলে মারফতি-মুর্শিদী-দেহতত্ত্বের গান। লম্বা চুলের গায়ক গলা ছাড়েন, ‘কোনখানেতে আছে আমার বিনা ধানের খই/ কোনখানেতে আছে আমার বিনা দুধের দই।’ মারফতি সুরে শ্রোতারা আকুল।
দুই
‘জলের মতন ঘুরে ঘুরে’ যৌবনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর রমনা ছিল সমার্থক। বুদ্ধদেব বসুর লেখা সেই সবুজ প্রসারিত রমনার আনন্দবেদনা মেশানো এক মিঠে ছবি আঁকা রয়েছে। বুদ্ধদেব বসু/ভবতোষ দত্তের সময়ের মতো আমাদের সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ‘সিভিল সার্ভিসের স্বাতন্ত্র্যে’ ছাত্রদের থেকে দূরে থাকেননি। কেউ কেউ বাড়িতে ছাত্রদের আপ্যায়ন করেছেন—এমন নজির রয়েছে। কারও ইউনিভার্সিটি পাড়ার বাড়িতেও আমরা গেছি। না চাইতে স্নেহ পেয়েছি প্রচুর।
সে সময়ের হেমন্তসন্ধ্যায় ফুলার রোড দিয়ে লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে তীব্র মিষ্টি সুবাস মনে করিয়ে দিয়ে দিত, কাছেই ফুল ধরেছে কোনো সুদর্শন ছাতিমগাছে। হেমন্তের সবচেয়ে নামজাদা ফুল ছাতিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার আর পাবলিক লাইব্রেরির ওপারে ছিল দিগন্ত প্রসারিত ঘোড়দৌড়ের এক সবুজ সতেজ মাঠ—যার আকাশে আকাশে মুক্তির আনন্দ আর অবারিত আলো। মাঠের অপর প্রান্তে রমনার কালীবাড়ি সারা দিন রোদ পোহায় পুকুরের বাঁধানো ঘাট। নাগরিক জীবনে ‘স্পেস’ বা উন্মুক্ত পরিবেশের জন্য হাঁসফাঁস করার যন্ত্রণা ছিল না তখন। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির পাশের ফাঁকা জায়গাটিতে তখনো বড় বড় গাছের জটলা বেড়ে ওঠেনি। নিচু এবং ফাঁক ফাঁক ইটের পাঁচিলঘেরা সেই খোলামেলা জায়গায় সবুজ ঘাসে ভরা চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নভেরা আহমদের কয়েকটি অপূর্ব ভাস্কর্য। সারা দিন ছাত্র-শিক্ষকদের আনাগোনা দেখে তারা নীরব চোখে। হেমন্ত রাতের জ্যোৎস্না মাখা প্রথম হিম ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে ওদের মসৃণ আধুনিক অবয়বে। সিমেন্ট বালুর তৈরি হলেও একধরনের নরম পেলবতা দৃষ্টিনন্দন অথচ অনুচ্চকিত এই ভাস্কর্যগুলো। আমাদের তরুণ অদীক্ষিত মনে আধুনিক ভাস্কর্যের প্রাথমিক ধারণা নেচে উঠেছিল নভেরার এই শিল্পকর্ম ঘিরে। সেই সবুজ ঘাসে ছাওয়া চত্বরের বদনে বড় গাছের নিচের ন্যাড়া মাটি এখন মৃতের মতো পড়ে রয়েছে। নভেরার এই শিল্পকর্মও বিদায় নিয়েছে। এখন ঠাঁই হয়েছে জাতীয় জাদুঘরের সামনের লনে। কষ্ট করে খুঁজে দেখতে হয় এদের।
সেই সময়ের এক দুপুরে রিকশা চেপে লাইব্রেরিতে যাচ্ছি। দেখি ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য দ্রুত হেঁটে আর্টস বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছেন ক্লাস নিতে। ধবধবে ফরসা চেহারা, চোখে গোল চশমা, গায়ে সাদা শার্ট প্রশান্ত মূর্তি। রিকশা না পেয়ে অগত্যা হেঁটেই ক্লাস ধরতে ছুটছেন। নেমে রিকশাওয়ালাকে বললাম তাঁকে আর্টস বিল্ডিংয়ে পৌঁছে দিতে।
সেই শেষ দেখা স্যারের সঙ্গে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তিনিও প্রাণ হারান স্বাধীনতার ঠিক আগে। ফুলার রোডে নিস্তব্ধ দুপুরে যেতে যেতে আজও চোখ বুজলে যেন দেখতে পাই—সন্তোষ স্যারকে। বুদ্ধিদীপ্ত গৌরবর্ণ চেহারা—গোল চশমা চোখে। দ্রুত হেঁটে চলেছেন ক্লাসে—যেন দেরি না হয়!
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত, লেখক।
[email protected]