২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

হেপাটাইটিস নির্মূলে আসুন খুঁজি লক্ষ অজানা রোগী

>
প্রথম আলো ও হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী অতিথিরা
প্রথম আলো ও হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী অতিথিরা
২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ উপলক্ষে প্রথম আলো ও হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা বাংলাদেশের আয়োজনে ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আসুন খুঁজি লক্ষ অজানা রোগী’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয় ২৭ জুলাই ২০২০। প্রথম আলোর ডিজিটাল স্টুডিও থেকে সম্প্রচারিত সেই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া আলোচকদের বক্তব্যের সারমর্ম এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

অধ্যাপক মবিন খান

সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম

সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ)

ডা. মো. শাহিনুল আলম

সাধারণ সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাক বাংলাদেশ। সহযোগী অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

ডা. মো. গোলাম আযম

বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ। সহযোগী অধ্যাপক, লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল।

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক

সাবেক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া।

অধ্যাপক তাহমীদ আহমেদ

সিনিয়র ডিরেক্টর, আইসিডিডিআরবি।

অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম

বিভাগীয় প্রধান, গাইনোকোলজি বিভাগ, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতাল।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু সাঈদ

সহসভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।

ডা. মো. গোলাম মোস্তফা

সহযোগী অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

ডা. মোতাহার হোসেন

কনসালট্যান্ট, লিভার ব্যাধি।

মিজানুর রহমান খান

যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

ডা. মো. সাইফুল ইসলাম এলিন

লিভার বিশেষজ্ঞ, লিভার বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

ডা. এস কে এম নাজমুল হাসান

সহকারী অধ্যাপক, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ।

ডা. তানভীর আহমাদ

সহকারী রেজিস্ট্রার ( মেডিসিন), কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী:সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে আজকের ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল আয়োজন। করোনার দুর্যোগেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা মিলিত হতে পেরেছি। হেপাটাইটিস আমাদের জন্য এক বিরাট সমস্যা। এর ফলে লিভার সিরোসিস, ক্যানসারও হতে পারে। সম্প্রসারিত টিকাদান কমসূচিতে হেপাটাইটিস বি -এর টিকা যুক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে হেপাটাইটিস আরও কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, এ বিষয়ে কাজ করা প্রয়োজন।

মো. গোলাম আযম
মো. গোলাম আযম

মো. গোলাম আযম
শুরুতেই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের পটভূমির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। চার্লস গোর নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি ১৯৯৫ সালে ‘হেপাটাইটিস সি’তে আক্রান্ত হন, পরে মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাঁর লিভার সিরোসিস রোগ শুরু হয়। ওই সময়ে হেপাটাইটিস সি–এর সঠিক চিকিৎসা নিয়ে কোনো সর্বসম্মত গাইডলাইন ছিল না। যা ছিল, তা–ও অনেক ব্যয়বহুল। ২০০০ সালে আরও তিনজন এ রকম রোগীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘হেপাটাইটিস সি ট্রাস্ট’ গঠন করেন। তারপরে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের রোগীদের নিয়ে ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর প্রথম ‘আন্তর্জাতিক হেপাটাইটিস সি সচেতনতা দিবস’ পালন শুরু করেন। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রোগী গ্রুপগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হেপাটাইটিস দিবস পালন করে আসছিল। এ জন্য ২০০৮ সালে সব রোগী গ্রুপ মিলে ‘ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স’ গঠন করে এবং ১৯ মেকে প্রথম ‘হেপাটাইটিস দিবস’ হিসেবে পালন শুরু করে।

বিশ্বব্যাপী রোগী কল্যাণ সমিতি এবং জনমতের ব্যাপক প্রচার–প্রচারণার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১০ সালের ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলি’তে একটি নীতি গ্রহণ করা হয়, যেখানে হেপাটাইটিস সি-এর সঙ্গে ‘হেপাটাইটিস বি’কেও সংযুক্ত করা হয়। হেপাটাইটিস বি-এর আবিষ্কারক বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৮ জুলাইকে ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’ ঘোষণা করা হয়।

অধ্যাপক বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ শুধু হেপাটাইটিস বি-এর আবিষ্কারকই নন, তিনি এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকাও আবিষ্কার করেন, যে কারণে তিনি ১৯৭৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিভিন্ন বছর নানা স্লোগান নিয়ে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে।

আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বা লিভারের প্রদাহ মূলত ভাইরাস দিয়ে হয়। মদ্যপানজনিত, ড্রাগ উদ্ভূত বা অটোইমিউনজনিত কারণেও হেপাটাইটিস হতে পারে। তবে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসজনিত কারণ, যা জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে ও টিকা প্রদানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

হেপাটাইটিস বি এবং সি লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার ও লিভার ফেইলিউরের কারণ। সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এভাবে মারা যায়, যা এইডসের মৃত্যুরে চেয়ে বহুগুণে বেশি।

হেপাটাইটিস বি–এর অতি কার্যকর টিকা এবং হেপাটাইটিস বি ও সি–এর নিরাময়যোগ্য ওষুধ সহজলভ্য হওয়ায় ২০১৬ সালে ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলি’ একটি উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব গ্রহণ করে। যেখানে ২০২০ সালের মধ্যে সব সদস্যদেশকে নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলা হয়, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিসকে এ বিশ্ব থেকে নির্মূল করা যায়।

মো. সাইফুল ইসলাম এলিন
মো. সাইফুল ইসলাম এলিন

মো. সাইফুল ইসলাম এলিন
যেকোনো বয়সী মানুষেরই হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে। হেপাটাইটিস বি-এর মাধ্যমে লিভার সিরোসিস, অ্যাকিউট হেপাটাইটিস, ক্রনিক হেপাটাইটিস, লিভার ক্যানসার হয়ে থাকে। অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৫ শতাংশ, ক্রনিক হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে প্রায় ৭৫ শতাংশ, লিভার সিরোসিসের ক্ষেত্রে প্রায় ৬০ শতাংশ এবং লিভার ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রায় ৬৫ শতাংশের জন্য হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দায়ী।

২০১৮ সালে দেশব্যাপী করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত জনসংখ্যা প্রায় ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এতে দেখা যায়, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা নারীর চেয়ে বেশি এবং গ্রামের মানুষ অপেক্ষা শহরের মানুষ এ ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত।

বর্তমানে কর্মক্ষম অনূর্ধ্ব–৩০ বছর বয়সী পুরুষ ও নারীর মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। এ ছাড়া ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রজননে সক্ষম নারীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। তাঁরাই আমাদের পরবর্তী হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমণের একটি উৎস। ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলে আমাদের যে পরিকল্পনা, তা ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেশনের কোনো বিকল্প নেই।

মো. গোলাম মোস্তফা
মো. গোলাম মোস্তফা

মো. গোলাম মোস্তফা
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রধানত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়। অনিরাপদ রক্তসঞ্চালন, অনিরাপদ সুই ও সিরিঞ্জ ব্যবহার এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্ক, সেলুনে অনিরাপদ শেভিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার, পারলারে নাক-কান ছিদ্রকারী অনিরাপদ যন্ত্রপাতির ব্যবহার—এসব উপায়েও হেপাটাইটিস বি ছড়াতে পারে। এ ছাড়া হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বহনকারী মায়ের কাছ থেকে নবজাতকের শরীরেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।

যারা মাদকাসক্ত, অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কে আসক্ত, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বহনকারী মায়ের নবজাতক, হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী এবং রক্ত গ্রহণকারীরা এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

আমাদের জেনে রাখা দরকার, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস করমর্দনের মাধ্যমে কিংবা কোলাকুলির মাধ্যমে ছড়ায় না। জামাকাপড়, থালাবাসনের মাধ্যমেও এটি ছড়ায় না।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের পরিণতি নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তি কোন বয়সে আক্রান্ত হয়, তার ওপর। যদি শিশু বয়সে কেউ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাহলে শতকরা ৫ ভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রতিকার হয়। আবার প্রাপ্তবয়স্ক কেউ যদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাহলে শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রতিকার হয়। অর্থাৎ শিশুদের ক্ষেত্রে শতকরা ৯৫ ভাগের মধ্যে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে শতকরা ৫ ভাগের মধ্যেই দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ থেকে যায়। যারা দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণে আক্রান্ত, তাদের মধ্যে অনেকেই লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার—উভয়ই প্রাণঘাতী রোগ।

ফেরদৌসী বেগম
ফেরদৌসী বেগম

ফেরদৌসী বেগম
হেপাটাইটিস গর্ভবতী মা থেকে শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। আমরা বলি এটির আশঙ্কা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করতে হবে, তা সফল করতে হলে গর্ভবতী সব মাকে হেপাটাইটিসমুক্ত রাখা জরুরি।

গর্ভবতী মা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে অপরিণত শিশু প্রসব ও শিশুর সংক্রমণ হতে পারে। গর্ভবতী মাকে অনেক সময় রক্ত দিতে হয়, সেখান থেকেও তিনি আক্রান্ত হতে পারেন। এটা একটা চক্রের মধ্যে পড়ে যাই আমরা। প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের হেপাটাইটিস পরীক্ষার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে জন্য এই টেস্টটা ফ্রি করে দিতে হবে। একজন নারীর গর্ভকালের চেয়ে আগেই হোপাটাইটিসের টিকা দেওয়া ভালো।

শিশুর সংক্রমণ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ, নবজাতক একবার আক্রান্ত হলে সে সারা জীবন ভুগবে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এখন জন্মের পরপর শিশুকে যে টিকা দেওয়া হয়, তার মধ্যে হেপাটাইটিস বি-এর টিকা অন্তর্ভুক্ত। শিশুর জন্মের পরপরই শিশুকে টিকা দিয়ে দিতে হবে। পরামর্শ হলো, জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে টিকা দিয়ে দিতে হবে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা। বিশেষ করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। এর গুরুত্ব বোঝাতে হবে। এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারক ও সাংবাদিকদের আরও বেশি উদ্যোগী হতে অনুরোধ করব।

নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম

নজরুল ইসলাম
ছোঁয়াচে জন্ডিসের বিবরণ দিয়েছেন গ্রিক মহাপুরুষ হিপোক্রেটিস। অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে জন্ডিস এর প্রাদুর্ভাবের বেশ কিছু প্রতিবেদন পাওয়া যায়। মেডিকেল জার্নালগুলোতে পাওয়া যায়, সেনা শিবিরে দূষিত পানি পানের অল্প সময়ের মধ্যে সংঘটিত জন্ডিস মহামারিতে রূপ নেওয়ার খবর।

১৮৮৩ সালে জার্মানির ব্রিমান শিপইয়ার্ডের কর্মীদের মধ্যে জন্ডিসের প্রাদুর্ভাবের ঘটনা প্রথম সিরাম হেপাটাইটিস রিপোর্ট হিসেবে ধরা হয়। সেখানে ১২৮৯ জন কর্মীকে গুটি বসন্তের টিকা দেওয়ার এক থেকে সাত মাস পর ১৯১ জন কর্মী জন্ডিসে আক্রান্ত হন।

১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো ভাইরাসকে জন্ডিসের কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়। তবে ১৯৩৭ সালে প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ধারণাকে তেমন পাত্তা দেওয়া হয়নি। এ সময় ২ হাজার ২০০ জনকে ইয়েলো ফিভারের টিকা দেওয়া হলে দুই থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেই ৫২ জন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন রকম পর্যালোচনা করার পর প্রমাণিত হয় যে ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার সময় যে হিউম্যান সিরাম ব্যবহার করা হয়েছিল, তা হেপাটাইটিস ভাইরাসে সংক্রমিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যৌনরোগ ক্লিনিকে একই সিরিঞ্জ ও সূঁচ দিয়ে দিয়ে অনেক রোগীকে ইনজেকশন দেয়া হতো। দেখা যেত এসব রোগীর মধ্যে কেউ কেউ এক থেকে তিন মাসের মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হতো। ধারণা করা হতো, একই সিরিঞ্জ ও সূঁচ ব্যবহারের ফলে এটা হতো।

১৯৪৭ সালে ম্যাককালাম প্রস্তাব দিলেন, পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে যে হেপাটাইটিস ছড়ায়, তাকে বলা হবে হেপাটাইটিস এ ভাইরাস। আর সূঁচ-সিরিঞ্জ কিংবা রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে যে হেপাটাইটিস ছড়ায়, তাকে বলা হবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। বর্তমানে হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই রয়েছে। আরও হেপাটাইটিস ভাইরাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। লিভার সেলে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের উপস্থিতি ছাড়া হেপাটাইটিস-ডি ভাইরাস জন্মাতে পারে না। তবে হেপাটাইটিস-ডি ভাইরাসের সাহায্যে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

মোজাহেরুল হক
মোজাহেরুল হক

মোজাহেরুল হক
সম্প্রসারিত টিকাদান কমসূচিতে (ইপিআই) হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ভ্যাকসিন যুক্ত করা হয়েছে। এতে এটার সহজলভ্যতার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি-এর প্রাদুর্ভাব অনেক কমে এসেছে।

বর্তমানে ভ্যাকসিনটির সহজলভ্যতা রয়েছে। এখন আক্রান্তদের ভ্যাকসিন ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। হেপাটাইটিস সম্পর্কে দেশের ১৭ কোটি মানুষকেই সচেতন করতে হবে। এটি শুধু সচেতনতা নয়, এটাকে আমরা বলি কমিউনিটি এনগেজমেন্ট, সেটির খুব দরকার। জনগণকে যুক্ত না করতে পারলে এটাকে নির্মূল করা যাবে না। আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করতে চাই, সে ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই।

অনেক সময় সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণেও সমস্যা হতে পারে। গণমাধ্যমকে যুক্ত করে অগ্রসর হতে হবে। কৌশল ঠিক করতে হবে। হোপাটোলজি সোসাইটি, সরকার এবং যারা জনস্বাস্থ্য ও হেপাটাইটিস নিয়ে কাজ করছে, তাদের সবাইকে নিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটা কৌশল ঠিক করা দরকার। কৌশল বলতে আমি বুঝি, কী পদ্ধতিতে হেপাটাইটিস নির্মূল করব, সেখানে কারা কারো যুক্ত থাকবে, সেটা ঠিক করা। কৌশলপত্রটা ঠিক করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কীভাবে অগ্রসর হতে পারি, সেটা নিয়ে আামাদের চিন্তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হোপাটোলজি সোসাইটি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে পারে।

আমরা সারা পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূল করেছি। আমি আশাবাদী, আমরা হেপাটাইটিসের মতো মরণব্যাধি বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করতে পারব।

মো. মোতাহার হোসেন
মো. মোতাহার হোসেন

মো. মোতাহার হোসেন
হেপাটাইটিস বি ও সি-এর ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।হেপাটাইটিস বি ও সি-এর রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য এ ভাইরাসগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা জরুরি। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য লিভার বিশেষজ্ঞ মাত্র ১০০ জন। আমাদের দেশের অধিকাংশ রোগী চাইলেও প্রথমেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারে না। জেলা সদরের বাইরে অধিকাংশ রোগী অনেকক্ষেত্রেই ভুল চিকিৎসার শিকার হন।

আমরা জানি, হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস কোনো সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশের পর এটির ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি পরিণতি হতে পারে: ১. অনেকের মধ্যে কোনো উপসর্গ সৃষ্টি ছাড়াই এটি আপনা–আপনি দেহ থেকে নির্মূল হয়ে যায়; ২. কারও কারও মধ্যে এটি স্বল্প মেয়াদের লিভার প্রদাহ বা অ্যাকিউট হেপাটাইটিস সৃষ্টি করে, এবং পরবর্তীকালে হয় সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যায়, অথবা দীর্ঘ মেয়াদে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সারা জীবন দেহে অবস্থান করে। কেউ কেউ ভাইরাসটি শরীরে বহন করেও সারা জীবন সুস্থ থাকে, আবার অনেকে ক্রনিক হেপাটাইটিসে ভোগে এবং সেখান থেকে সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়।

রোগের প্রতিটি স্তরে রোগীর উপসর্গ, দৈহিক পরিবর্তন ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দিতে হয়। এটি মূলত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাজ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাদানকারীরা অ্যাকিউট হেপাটাইটিস রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন এবং হেলদি ক্যারিয়ার যাঁরা, তাঁদের ফলোআপে সাহায্য করবেন, তাঁরা কোনো জটিলতায় যাচ্ছেন মনে করলে তাঁদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাদানকারীরা কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি ও সি শনাক্তকরণ পরীক্ষা করাবেন, কী কী পরীক্ষা করাবেন এবং কখন তাঁকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন, এ ব্যাপারে সরকারিভাবে একটি জাতীয় নীতিমালা থাকা দরকার। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগ নির্ণয়ের ন্যুনতম কিছু পরীক্ষা সহজলভ্য করা প্রয়োজন।

তানভীর আহমেদ
তানভীর আহমেদ

তানভীর আহমেদ
বিশ্ব আজ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মহামারির সময় অতিক্রম করছে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি লিভারের রোগ যেমন ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ও সি রোগীরা করোনা মহামারিতে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ক্রনিক হেপাটাইটিস বি কিংবা সিতে ভুগছেন বা যাঁদের এই ভাইরাসের কারণে ইতিমধ্যেই লিভার সিরোসিস হয়েছে, তাঁরা গুরুতর কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি লিভার ফেইলিউর হওয়ার বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছেন।

ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস রোগীরা করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে কী করবেন?হেপাটাইটিস বি ও সি–এর জন্য চলমান অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বন্ধ না করা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন না করা। মৃদু রোগের ক্ষেত্রে বাসায় থেকেই চিকিৎসা করা। গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।

মোহাম্মদ আবু সাঈদ
মোহাম্মদ আবু সাঈদ

মোহাম্মদ আবু সাঈদ
হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগী দুই ধরনের: স্বল্পমেয়াদী (অ্যাকিউট), যাদের স্থায়িত্ব ছয় মাসের কম এবং দীর্ঘমেয়াদী (ক্রনিক), যাদের স্থায়িত্ব ছয় মাসের বেশি। আমাদের মনোযোগ দীর্ঘমেয়াদী আক্রান্ত রোগীর প্রতি। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীর ভাইরাসের পরিমাণ কমানো অথবা নির্মূল করা গেলে এ রোগের খারাপ পরিণতি যেমন: লিভার সিরোসিস, লিভার ফেইলিওর ও লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এইচবিএস-এজি পজিটিভ রোগীদের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। ভাইরাস যদি লিভারে প্রদাহ না করে, তাদেরকে আমরা ইনঅ্যাকটিভ ক্যারিয়ার বলে থাকি, যাদের কোনো এন্টিভাইরাল ওষুধের প্রয়োজন হয় না। শুধু ওই ১০ থেকে ২০ ভাগ আক্রান্ত রোগীর, যাদের লিভারে প্রদাহ থাকে, শুধু তাদেরই এন্টিভাইরাল চিকিৎসা দেওয়া হয়। দুই ধরনের ওষুধ যথা ইন্টারফেরন ইনজেকশন ও খাবার বড়ি জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে আমাদের দেশে বেশির ভাগ রোগী খাবারের বড়ির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। দৈনিক একটি বড়ি খেতে হয়, যাতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নাই বললেই চলে। দামও রোগীর সামর্থের মধ্যে।

হেপাটাইটিস-সি শনাক্ত হয় এইচসিভি-আরএনএ পজিটিভ হলে। এ রোগের জন্য ২০১৪ সালের পূর্বে ইন্টারফেরন ইনজেকশন ব্যবহার হতো, যা উচ্চমূল্য ও অধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে আজকাল ব্যবহার করা হয় না। আধুনিক বিশ্বের মতো খাবার বড়ি, দুটি ওষুধ একই বড়ির মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। যাদের লিভার সিরোসিস হয়নি তাদেরকে মাত্র ১২ সপ্তাহ এবং সিরোসিস আক্রান্ত রোগীদের ২৪ সপ্তাহের এই ওষুধ সেবনের মাধ্যমে ৯৫ থেকে ৯৮ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এই ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক কম, কাজেই হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসা যুগান্তকারী বলা হয়।

এস কে এম নাজমুল হাসান
এস কে এম নাজমুল হাসান

এস কে এম নাজমুল হাসান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীব্যাপী প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। মোট আক্রান্তের ২৭ মিলিয়ন (মোট আক্রান্তের ১০.৫৭ শতাংশ) তাঁদের রোগ সম্পর্কে অবগত। বিপরীতে মোট আক্রান্তের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ তাঁদের রোগ সম্পর্কে অবগত নন।

দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের ফলে সংক্রমিতদের ২৫ শতাংশের লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে মারা যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণজনিত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত রোগসমূহ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে।

লক্ষ অজানা হেপাটাইটিস রোগী খুঁজে বের করে আনার প্রথম পদক্ষেপ হলো অধিকসংখ্যক মানুষকে ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা। সে জন্য সব গর্ভবতী নারীকে, হাসপাতালে ভর্তি করা সব রোগীকে, বেসরকারি ক্লিনিকে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবা নিতে আসা সবাইকে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, মাদকাসক্ত, রক্তগ্রহীতা, আক্রান্ত রোগীর নিবিড় সম্পর্কে আসা ব্যক্তিবর্গকে শনাক্তকরণ পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে।

রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সহজলভ্য করতে পারলে সাধারণ লোকজন এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত হবে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ইপিআই কার্যক্রমের কথা বলা যায়। বাংলাদেশে ২০০৪ সালে হেপাটাইটিস বি টিকা ইপিআই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গ্লোবাল হেলথ অজজারভেটরি রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায়, ২০০৩ সালে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে শিশুদের টিকাপ্রাপ্তির হার ছিল ৫ শতাংশ, কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৯৫ শতাংশ। তাই আমি মনে করি, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে করা উচিত।

তাহমীদ আহমেদ
তাহমীদ আহমেদ

তাহমীদ আহমেদ
এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয়টি (এসডিজি-৩) হলো স্বাস্থ্যসম্পর্কিত। ১৭টি লক্ষ্যের ৫টির মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সির চিকিৎসা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

সম্প্রসারিত টিকাদান কমসূচিতে (ইপিআই) আমাদের যে সাফল্যের কথা আমরা বলছি, যেটার কাভারেজ এখন ৯০ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণের হার কমে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো আক্রান্তের হার উল্লেখযোগ্য। ইপিআইতে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০০৪ সালে। কিন্তু এখনো অনেকে ভ্যাকসিনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ১৬-১৭ বছর বয়সী গ্রুপ, প্রসূতিরা আছেন, তাঁদের টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য পরীক্ষা বাড়াতে হবে। আক্রান্তের ৮০ শতাংশ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমরা যদি এসডিজির দিকে তাকাই, ২০৩০ সাল হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর শেষ বছর। সেই বছরে আমাদের কতগুলো বিষয় করার কথা। হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত কমাতে হবে ৯০ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ রক্ত সঞ্চালন শতভাগ কমাতে হবে। এটা যদি আমরা না পারি, তাহলে এসডিজি আমরা কোনোক্রমেই অর্জন করতে পারব না। এখন হেপাটাইটিস আক্রান্ত রোগী ৬৬ লাখ। ২০৩০ সালের মধ্যে এটা কমিয়ে ৬ থেকে ৭ লাখে নামিয়ে আনতে হবে।

ভ্যাকসিন কাভারেজ বর্তমানে ৯০ শতাংশের বেশি। এটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়া ইপিআইয়ের আওতার বাইরে থাকা মানুষদের শনাক্তকরণ বাড়াতে হবে এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসাসুবিধা শুধু বড় বড় হাসপাতালে সীমাবদ্ধ না রেখে জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতেও সম্প্রসারিত করতে হবে।

মিজানুর রহমান খান
মিজানুর রহমান খান

মিজানুর রহমান খান
হেলথ কমিউনিকেশন শব্দটা খুব গুরুত্ব পাচ্ছে হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে। এটাকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন দ্য মেইন কারেন্সি অব হেলথ কেয়ার ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি। তো এতেই বোঝা যাচ্ছে গণমাধ্যমে ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ।

হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই জানে না যে তারা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। এখানে সচেতন করার ক্ষেত্রে আমি তো দেখি মিডিয়ার রোলটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

নাইজেরিয়ায় একটা স্টাডি হয়েছিল ২০১৭ সালে। সেখানে দেখা গেছে, হেপাটাইটিস বিষয়ে ৬২ শতাংশ মানুষ নাইজেরিয়ার চারটা শীর্ষ দৈনিকের মাধ্যমে তা জানতে পেরেছে, আর ৪২ শতাংশ জানতে পেরেছে ইন্টারনেট থেকে।

হেলথ কমিউনিকেশন বিষয়টার ওপর জোর দিতে হবে- মিডিয়ার সঙ্গে, এমনকি নিউ মিডিয়ার সঙ্গেও। হেলথ কমিউনিকেশনকে কী করে আরও কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এমবিবিএস সিলেবাসে হেলথ কমিউনিকেশন নিয়ে ১০ বা ১৫ নম্বরের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, ভেবে দেখা যেতে পারে। এখানে বিশেষজ্ঞ যাঁরা আছেন, তাঁরা এই বিষয়টার দিকে একটুখানি বিশেষ মনোযোগ দেবেন বলে আশা রাখি।

তৃণমূল পর্যন্ত টেস্ট করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আলট্রাসনোগ্রামসহ ৯ ধরনের টেস্ট করতে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা লাগে। নবজাতক ও মায়ের স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপর্ণ। অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে খরচ পড়ে প্রায় তিন হাজার টাকা। তো আমাদের দেশে একজন সাধারণ মা এই পরিমাণ টাকা দেবেন কীভাবে? আমি ড. বিজন কুমার শীলের সঙ্গে কথা বলেছি, হেপাটাইটিসের টিকা এবং হেপাটাইটিসের অ্যান্টিবডি টেস্টের কিট আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারি কি না। তিনি বললেন, এটা সম্ভব। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।

মো. শাহিনুল আলম
মো. শাহিনুল আলম

মো. শাহিনুল আলম
হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত দেশব্যাপী জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি অথবা হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ৯০ লাখ মানুষই জানে না যে তারা হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুরা জন্মের সময় অথবা কাছাকাছি সময়ে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। অস্ত্রোপচার, ডায়ালাইসিস, নিডল শেয়ারিং, রক্ত বা রক্তজাত দ্রব্য গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি এবং/অথবা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।

বাংলাদেশে সাধারণ জন্ডিসের প্রধান কারণ পানিবাহিত (বা খাবারবাহিত) ভাইরাস হেপাটাইটিস ই (এবং হেপাটাইটিস এ)। আকস্মিক লিভার ফেইলিউরের প্রধান কারণ এটি। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম শহরে হেপাটাইটিস ই-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে শত শত মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ১%-২%-এর মৃত্যু হয়। আমাদের বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা না থাকায় বেশির ভাগ শহরই এমন প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি লিভার রোগীর জন্য মাত্র ১০০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। আমাদের ১ হাজার জন বিশেষঞ্জ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার।

এমতাবস্থায়, ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস-২০২০’ উপলক্ষে ‘হেপাটোলজি সোসাইটি’, ঢাকা বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হেপাটাইটিস নির্মূলে নিম্নলিখিত সুপারিশমালা পেশ করছে:

১. এইচবিএস-এজি (HBsAg) ও এন্টি-এইচসিভি (Anti-HCV) পরীক্ষা বিনা মূল্যে করা। ২. গর্ভকালীন, অস্ত্রোপচার, ডায়ালাইসিস ও রক্ত বা রক্তজাত দ্রব্য গ্রহণের আগে উল্লিখিত পরীক্ষা সর্বত্র নিশ্চিত করা। ৩. জন্মের পরপরই শিশুকে হেপাটাইটিস ‘বি’-এর টিকাদান নিশ্চিত করা। ৪. ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিনা মূল্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও হেপাটাইটিস ‘সি’-এর চিকিৎসা নিশ্চিত করা। ৫. সব শহরে ও গ্রামে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৬. এক হাজার লিভার বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ৭. কোভিড-১৯-এর মধ্যেও হেপাটাইটিসের চিকিৎসা অব্যাহত রাখা।

অংশগ্রহণকারী সকলকে হেপাটোলজি সোসাইটির পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

মবিন খান
মবিন খান

মবিন খান
কোভিড-১৯-এর স্বল্পমেয়াদি মহামারি আকারে বিস্তারের ফলে সবাই এর ভয়াবহতায় আতঙ্কিত। কিন্তু সংখ্যার বিচারে হেপাটাইটিস বি এবং সি সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ আক্রান্ত রয়েছে। এই ভাইরাসগুলো ধীরে ধীরে লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা মানুষ প্রথম পর্যায়ে বুঝতে পারে না।

আশঙ্কার বিষয় হলো, বিশ্বের ৩৩ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ২৯ কোটি মানুষ জানে না যে তারা তাদের রক্তে হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস বহন করছে। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন লিভারের ক্রনিক ইনফ্লামেশন অনেক দূর অগ্রসর হয়ে যায়। তাই এ বছরের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আসুন খুঁজি লক্ষ অজানা রোগী’।

সারা বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ৯ জন ব্যক্তি জানে না তারা হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের জীবাণু বহন করছে। ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স ২০৩০ সাল নাগাদ ৯৫ শতাংশ অনির্ণীত রোগীকে রোগনির্ণয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অধিকন্তু, ২০৩০ সাল নাগাদ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দেশের প্রায় ৬৬ লাখ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজারে নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে। ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স ২০৩০ সাল নাগাদ ৯৫ শতাংশ অনির্ণীত রোগীর রোগনির্ণয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অনির্ণীত রোগীসহ দেশে মোট হেপাটাইটিস রোগী প্রায় এক কোটি।

২০৩০ সাল নাগাদ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস নির্মূলের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দেশের প্রায় ৬৬ লাখ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজারে নামিয়ে আনতে হবে। উক্ত লক্ষ্য পূরণে সাফল্য পেতে হলে বাংলাদেশের অজানা রোগীদের শনাক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিবছর বিশ্বের ১৬০টি দেশের সঙ্গে আমরাও বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করে আসছি। হেপাটোলজি সোসাইটি কর্তৃক হেপাটাইটিস বি ও সি নির্মূলে প্রস্তাবিত বিষয়গুলো আমলে নিয়ে বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টর ২০৩০ সাল নাগাদ হেপাটাইটিস নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখছি।

ফিরোজ চৌধুরী

বাংলাদেশ থেকে হেপাটাইটিস দূরীকরণে সরকার, জনগণ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। আজকের ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।