স্কুলে মেয়েরা কেন লম্বা আয়না চায়?

একটি সামান্য আয়না, ঘরের কাছাকাছি একটি টয়লেট, পর্যাপ্ত স্যানিটারি প্যাড, প্যাড পরিবর্তন করার সুব্যবস্থা, ব্যবহৃত প্যাড ফেলার জন্য ঢাকনাওয়ালা বালতি, সার্বক্ষণিক পানির সাপ্লাই, একটি সাবান অনেক সহজ করে দিতে পারে একজন নারীর জীবন।

স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিলাম। এক দিন আগে-পরে। একই রুমে বন্দী হয়ে করোনার সঙ্গে লড়াই করে মাত্র মুক্তি মিলল।দুজনের একই সঙ্গে চিকিৎসা শুরু হয়েছে, একই খাবার খেয়েছি। তারপরও আমার অবস্থাটাই যেন বেশি নাজুক ছিল। প্রকৃত কারণ গবেষক-চিকিৎসকেরা বলতে পারবেন, কিন্তু আমার মনে হয়, আমার করোনাকালীন সবচেয়ে জটিলতম সময়কে আরও জটিল করে দিয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে চলা অতিমাত্রার পিরিয়ড।

যখন আমি জ্বরে ভুগছি, ঘুম হচ্ছে না, বমির কারণে ঠিকমতো খেতে পারছি না, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে আসছে, ঠিক তখন পিরিয়ড শুরু হয়। এটা আসন্ন মেনোপজের লক্ষণ ছিল কি না জানি না, তবে তা প্রায় আট দিন যাবৎ চলতে থাকে। সেই সময়টাতে আমার এতটা দুর্বল লাগত যে চার-পাঁচ মিনিটের বেশি বসে থাকতে পারতাম না। শুয়ে থেকে খাবার খেতাম। অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে নিজের পোশাক আর বিছানা-চাদর পরিষ্কার রাখতে বারবার বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করছিলাম। কিন্তু একটা সময় সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। প্রায় অজ্ঞানের মতো বিছানার একপাশে পড়ে থাকলাম। অন্যপাশ থেকে স্বামী তখন কিসের পর কী করতে হবে, ক্রমাগত তার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি খাবার ও ওষুধগুলো হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। আমিও চেষ্টা করছিলাম তাঁর নির্দেশ পালন করতে। এভাবে যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে একসময় সেরে উঠলাম।

আজ সেই চরম সময়গুলোর কথা স্মরণ করে এটাই মনে হয় যে নারী বলে আমাকে বাড়তি কিছু জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হলো। সেই সময়ে পিরিয়ড না হলে আমাকে হয়তো এতটা ভুগতে হতো না। অবশ্য প্রত্যেক সুস্থ নারীর জীবনে পিরিয়ড বা মাসিক স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু আমি এ-ও ভাবি, যদি টয়লেটটা ঘর থেকে দূরে হতো, স্যানিটারি প্যাডের বদলে আমাকে কাপড়ের টুকরা ব্যবহার করতে ও তা ধুয়ে শুকাতে হতো, খাবার ও ওষুধ মুখে তুলে দেওয়ার মতো কেউ পাশে না থাকত, তবে কী অবস্থা হতো আমার?

আমার এ ছোট ছোট প্রয়োজনের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল কয়েক বছর আগের কথা। ২০১৯-এর মাঝামাঝি। হাইস্কুলগুলোতে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা জানতে খুলনা শহরের সাতটি স্কুলে গিয়েছিলাম। ছাত্রী ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করেছি। ছাত্রদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার এবং দলগত আলোচনায় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নানান চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের দিক উঠে এসেছিল। জেনেছিলাম শুধু দুর্গন্ধ ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে বেশির ভাগ ছাত্রী স্কুলে টয়লেট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে।

স্বনামধন্য একটি স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ের কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে আলাপকালে তাদের ছোট্ট একটি চাহিদার কথা শুনেছিলাম। স্কুলের টয়লেটে তাদের একটা লম্বা আয়না দরকার। অবাক হয়ে দেখেছি, তাদের চাহিদাটা আমার মতো অনেকেরই চাহিদা। তারা জানাল, তাদের টয়লেটে অনেকগুলো বেসিন আছে। তার ওপরে সুন্দর আয়নাও লাগানো আছে। চেহারা দেখতে, এলোমেলো চুল আঁচড়ে নিতে, ক্লিপ বা হিজাবের পিনটা ঠিক করে লাগাতে বেশ কাজে দেয় আয়না। কিন্তু তাদের বেশি দরকার একটা লম্বা আয়না।

মাসিক চলাকালীন অনেক সময় প্যাড, পায়জামা ভেদ করে রক্ত কামিজেও লেগে যায়। যার কারণে তাদের স্কুলে ও পথে ভীষণভাবে বিব্রত হতে হয়। স্কুলের টয়লেটে একটা লম্বা আয়না থাকলে তারা তাদের পেছনের দিকটা ঠিক আছে কি না, দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। যেসব স্কুলের ছাত্রীদের স্কুলড্রেস সাদা বা হালকা রঙের, তাদের অনেকের মধ্যে ওই সময়টা ঘিরে একধরনের আতঙ্ক কাজ করে। বিশেষ করে যেসব স্কুলে ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে পড়ে কিংবা স্কুলে অনেক পুরুষ শিক্ষক আছেন। এ সময়টাতে অনেক ছাত্রী তাই স্কুলে যায় না।

একটি সামান্য আয়না, ঘরের কাছাকাছি একটি টয়লেট, পর্যাপ্ত স্যানিটারি প্যাড, প্যাড পরিবর্তন করার সুব্যবস্থা, ব্যবহৃত প্যাড ফেলার জন্য ঢাকনাওয়ালা বালতি, সার্বক্ষণিক পানির সাপ্লাই, একটি সাবান ইত্যাদি কিছু বিষয় পারে একজন নারীর জীবনকে অনেক সহজ করে দিতে। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার পথে নারীর এ চাওয়াটুকু খুব বেশি কিছু নয়। প্রতিটি বাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে, চলার পথে, কর্মক্ষেত্রে এ সুবিধাগুলো কী নিশ্চিত করতে পারে না আমাদের পরিবার, সমাজ তথা দেশ?

আজ ২৮ মে ২০২১ বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের জন্য মূল প্রতিপাদ্য ‘মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খাতে আরও বেশি কাজ, আরও বেশি বিনিয়োগ হোক এখনই’। নারীর প্রয়োজনগুলোকে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখে সব কাজের পরিকল্পনা, বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই আমাদের পক্ষে দিনটির উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব।

কেকা অধিকারী লেখক ও উন্নয়নকর্মী