সুশাসন ও অর্থনৈতিক গতিধারার সংকট প্রশ্নে

উপরোল্লিখিত শিরোনামে অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার গত ২৮ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায় প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বর্তমানে দেশের তিনটি সংকট চিহ্নিত করেছেন: রাজনৈতিক সংকট, সুশাসন সংকট, অর্থনৈতিক গতিধারার সংকট। প্রথমটি রাজনীতিবিদেরা সমাধান করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির বিষয়ে নাগরিক সমাজকে আলোচনা করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতি সর্বগ্রাসী বিস্তার লাভ করেছে, সেটা সবাই জানে। দলীয়করণ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং তার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন—ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির লাইসেন্স সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে জড়িত ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কাজ ভবিষ্যতে যাতে না হয়, তার জন্য কৌশল নির্ণয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকতে হলে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে কার্য পরিচালনা করতে হবে। তত্ত্বগত দিক থেকে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি করাই দুর্নীতি কমানোর বড় হাতিয়ার।
সুশাসনের বিষয়ে শিক্ষাব্যবস্থার কথা আলোচনা করা হয়েছে। তিনি যথার্থই বলেছেন, শিক্ষা খাতে মান চরমভাবে নিম্নগামী হয়েছে। দেশের মানুষ অবৈতনিক শিক্ষা চায় বলে মনে হয় না। কোচিং ক্লাস করার জন্য ছাত্রদের ব্যয় করতে হয় অনেক টাকা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে চরম অবনতি হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঢালাওভাবে জাতীয়করণের জন্য। অনেক স্কুল-কলেজে ভালো শিক্ষক নেই। সমগ্র পৃথিবী যখন মেধাচর্চার দিকে বেশি বেশি নজর দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে গ্রেড-স্ফীতি ও পাস না করলেও পরের ক্লাসে উঠতে দেওয়া বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি ফলাফল প্রকাশের পর অনুত্তীর্ণ ছাত্রদের দাবির মুখে গণপ্রমোশন দেওয়া শিক্ষার মান কমে যাওয়ার ফল। মধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে যেমন দক্ষতা লাগবে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তার বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। ভবিষ্যতে এসব আধা শিক্ষিতরা অধিক হারে দেশের রাজনৈতিক দলের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেবেন এবং চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়বে। ভবিষ্যতে এঁদের দুরবস্থা দেখে নতুন শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহী হবেন এবং শিক্ষাবিমুখতা বৃদ্ধি পাবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া প্রধান জাতীয় লক্ষ্য হওয়া উচিত। তার জন্য অধিক অর্থ বরাদ্দ করা যেমন প্রয়োজন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ও সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। নাগরিক সমাজকে এ বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারা উচিত।
পাকিস্তান আমল থেকে যে ব্যবস্থা চলে এসেছে, আমরা সেটারই সম্প্রসারণ করেছি কেবল। তখন স্থানীয়ভাবে রাজনীতি ছিল না। এখন রাজনীতিকেরা সবই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এবং দলের পরামর্শে শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন। এভাবে নিয়োজিত ব্যক্তিরা কারও কাছেই দায়বদ্ধ থাকেন না। এই ধারাকে রোধ করতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন অবশ্যই ব্যাহত হবে। স্কুল-কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে শিক্ষকদের প্রাধান্য দিতে হবে এবং রাজনীতির বাইরে থাকা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সংযুক্ত করতে হবে। ভালো শিক্ষক না থাকলে কিছু স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া ভালো হবে। ১০টা খারাপ স্কুলের পরিবর্তে দুটি ভালো স্কুল থাকা উচিত।
বর্তমান সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প সম্পর্কে যতটা বলা হয়, ততটা কাজ হয়েছে কি না; জানা যায় না। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধি করার অনেক সুযোগ আছে। বছরে বোধ হয় কোটি কোটি টাকার দুধ আমদানি হয়। ভালো জাতের গাভি পালনে উৎসাহ দিলে এই আমদানিনির্ভরতা অর্ধেকের নিচে নামবে। খাদ্যে আমিষের পরিমাণ বাড়াতে হলে পোলট্রি, গরু-ছাগল বা মাছের চাষ বাড়ানোর সুযোগ আছে। এগুলোয় বিনিয়োগ বাড়লে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান হবে এবং স্থানীয়ভাবে মূল্য সংযোজন হবে। দেশের চরাঞ্চলের জন্য বিশেষ ধরনের কৃষি প্রকল্প নিতে হবে। বাদাম, মিষ্টি আলু ও অন্যান্য শাকসবজি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। শেষ সময়ে এসে সরকার উপকূল এলাকায় কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশাল প্রকল্প নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এই উদ্যোগ সরকারের প্রথম বছরে নিলে জাতীয় আয় আরও ১ শতাংশ বাড়ত। যাহোক, এই উদ্যোগ উন্নয়নের ধারা পরিবর্তনে সহায়ক হবে অবশ্যই।
কৃষিতে উৎপাদন বাড়লেও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা ভালো না থাকায় কৃষকেরা যথেষ্ট মূল্য পান না। অথচ তিন-চার টাকার পটোল বা বেগুন ঢাকায় এসে ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়। সে ক্ষেত্রে দুটি কাজ করা যায়। প্রথমত, এলাকাভিত্তিক সোলার প্যানেল ব্যবহার করে কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, পণ্যের বড় চালান পরিবহনের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ রেলওয়েতে অনেক দিন বিনিয়োগ হয় না। এসব পচনশীল কৃষিপণ্যের জন্য বিশেষ ট্রেন চালু করতে হবে— ভারতে যেমন দুধের ট্রেন চলে। বাংলাদেশ রেলওয়ে কলা, শাকসবজি ও তাজা মাছ পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারে। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুর জেলায় চরাঞ্চলসহ কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিতে হবে। সেটার বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতে অবদান নিশ্চিত করতে হবে। অনেক এনজিও ওই এলাকায় কাজ করছে। কিন্তু উৎপাদন ও বিপণনের সমন্বয়ের ব্যবস্থা না থাকায় ক্রেতারা বেশি দাম দিচ্ছে,
কিন্তু কৃষকেরা ভালো দাম পাচ্ছেন না। ঢাকার চারদিকে কয়েকটি কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার স্থাপন করলে শহরের ভেতরের বাজারের ওপর চাপ কমবে। অনেক লোক ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে ওই সব বাজার থেকে সুলভে কৃষিপণ্য কিনতে পারবেন।
এডিপিতে অনেক সেতু, কালভার্ট ও রাস্তা নির্মাণ অনেক বছর থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে অল্প অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে। এসব প্রকল্প বাদ দিয়ে চরাঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চল ও কুটিরশিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এসব বিনিয়োগ বাড়লে শহরের বাইরে কর্মসংস্থান বাড়বে, বেকারত্ব কমবে এবং জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার বেশি হবে। বেকারত্বের হ্রাস করাই হবে জাতীয় পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। বছরে ২০ লাখ নতুন লোক কর্মক্ষেত্রে আসছে। তাদের লক্ষ রেখেই সব পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেওয়া অবশ্যই উচিত হবে। অন্ততপক্ষে এসএসসি পাস এবং তার ওপরে ডিগ্রিধারীদের জন্য তথ্যভান্ডার প্রস্তুত করে ক্রমান্বয়ে প্রশিক্ষণ ও বেকার ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এদের অনেককেই কর্মক্ষম করতে হলে ভোকেশনাল ট্রেনিং দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার ফারাক ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণ করতে হলে প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
খবরের কাগজে ও অন্যান্য মাধ্যমে দেশবাসী অর্থের অপব্যবহারের বড় বড় উদাহরণ ভালোভাবেই জানে। শেয়ারবাজারে লুটপাট, হল-মার্ক ও অন্যান্য গ্রুপের ব্যবসায়ীরা সরকারি ব্যাংক থেকে ভুয়া প্রকল্প ও কাগজপত্র দিয়ে চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের নামে উধাও করেছেন। ডেসটিনি গ্রুপ একাই কয়েক হাজার কোটি টাকা মানুষের পকেট থেকে নিয়েছে, এ কারণে ওই সব ব্যাংকের মূলধন-ঘাটতি বেড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের জন্য প্রভিশন বেড়েছে। ওই ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে এমনি পিছিয়ে আছে এবং প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে। আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর বড় কারণ, এই খাতে মেধার বদলে দলীয়করণ করা হয়েছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। আর্থিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হলে সরকারি ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে শিগগির পিএলসিতে পরিবর্তন করতে হবে। নতুন শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে মালিকানা হস্তান্তর করা যেতে পারে। কিংবা বেসরকারি খাতের ব্যাংক-বিমা কোম্পানির সঙ্গে একীভূত করার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে, গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্য ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণব্যবস্থার মডেল গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। তাদের কু-ঋণের পরিমাণ খুবই কম। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহী করতে হবে অধিক পরিমাণে জনশক্তিকে কাজ দেওয়ার জন্য।
হোসেন জিল্লুর রহমান সত্যিকার অর্থেই দেশে সুশাসন ও অর্থনৈতিক গতিধারার সংকটের প্রশ্ন উপস্থাপন করে ভালো কাজ করেছেন। আশা করি, নাগরিক সমাজের অন্যরাও এসব ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করবেন এবং মতামত দেবেন।
অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক: উপাচার্য, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।