বিশ্ব জুড়ে মিয়ানমারের জন্য বিশেষ কুখ্যাতি ছিল সামরিক শাসনের জন্য। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর গত ৭২ বছরে মিয়ানমার মাত্র ১৫ বছরের মতো বেসামরিক সরকারের অধীনে কাটিয়েছে। সেই দুর্ভাগ্য আবারও জেঁকে বসেছে দেশটিতে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নতুন পার্লামেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে গতকাল সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করেছে দেশটিতে।
অং সান সু চিকে আটকের পাশাপাশি শাসক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রায় সব পরিষদ সদস্যকে বন্দী করা হয়েছে একই সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট ইউনি মিন্টও সশস্ত্র বাহিনীর কবজায় রয়েছেন। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির এই নাটকীয়তায় পুরো বিশ্ব হতবাক হয়ে গেছে।
আবার সব ক্ষমতা জেনারেলদের হাতে
গত কয়েক দিন থেকেই মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের গুজব চলছিল। অনেকে এটা বিশ্বাস করেনি। সু চির সঙ্গে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের দর-কষাকষি চলছিল—সেটা যাঁরা জানতেন, তাঁরা অভ্যুত্থানের গুজবকে মনে করেছেন সেনাবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ। উদীয়মান নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সেনাবাহিনী এভাবে গলা টিপে হত্যা করতে পারে—সেটা স্বাভাবিক বিবেচনায় বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। কিন্তু বাস্তবতা কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। দেশটিতে সেনাবাহিনী যে গণতন্ত্রকে শিকড় মেলতে দিতে চায় না, তাই প্রমাণ হলো। আজই সেখানে নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা। তার আগে নাটকীয়ভাবে দেশজুড়ে এনএলডির জনপ্রতিনিধিদের আটক করেছে সশস্ত্র বাহিনী। প্রেসিডেন্ট এবং এনএলডির নেত্রী অং সান সু চিও জেনারেলদের হাতে বন্দী এখন। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী সমর্থক হিসেবে পরিচিত মিয়াদ্দি নিউজ জানিয়ে যাচ্ছে, দেশে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়েছে এবং সব ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনী তার এখতিয়ারে নিয়েছে। এ অধ্যায়ের কৌতূককর দিক হলো, সেনাবাহিনী জানাচ্ছে তারা সংবিধানের বিধান অনুযায়ীই ক্ষমতা নিয়েছে। তারা একজন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও নিয়োগ দিয়েছে।
কেন এ সময় এই ঘটনা ঘটল
অভাবনীয় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন শেষে নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগমুহূর্তে কেন মিয়ানমারে এ রকম ঘটনা ঘটল, তার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করছেন এই মুহূর্তে রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা। এর ব্যাখ্যা খুব কঠিন নয়। দেশটিতে গণতন্ত্রের জমিন শক্ত হতে দিতে চান না জেনারেলরা। তাঁদের পেছনে আঞ্চলিক মদদও আছে।
সু চি এবং এনএলডি গত নির্বাচনের চেয়েও এবার বেশি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হতে চলেছিল। মিয়ানমারজুড়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোতে ভোট হয় ১ হাজার ১৭১টি আসনে। এবার ভোট হয়েছিল ১ হাজার ১১৭ আসনে এবং তাতে সু চির দল একাই পেয়েছে ৯২০ আসন, যা গতবারের চেয়েও ৬৬টি বেশি।
এভাবে কয়েক মেয়াদে দেশটিতে রাজনীতিবিদদের বেসামরিক সরকার কাজ করলে সমাজে সশস্ত্র বাহিনীর পুরোনো কর্তৃত্ব কমে আসার যে প্রবণতা শুরু হবে, সেটা হতে দিতে চাইছে না জেনারেল গোষ্ঠী। বিশেষ করে সর্বশেষ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থক রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) অত্যন্ত খারাপ ফল করে। তারা মাত্র ৭১টি আসন পায়, যা গতবারের চেয়ে ৪৬টি কম। মূলত এই ঘটনায় সেনাবাহিনী জনগণের স্বাধীন মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। ইউএসডিপি এ রকম খারাপ ফল করবে এটা ‘টাটমা-ড’ নামে পরিচিত মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী এবং তার গোয়েন্দা অনুমানকেও বোকা বানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ অনেক কমে যায়।
সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ভেবে রেখেছিলেন ইউএসডিপি নির্বাচনে ভালো করলে সু চির সঙ্গে দর-কষাকষি করে তিনি উর্দি ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হবেন। জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাঁর সেই ইচ্ছায় বাদ সাধে। বলা যায়, গত নভেম্বরের ভোটে সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পনামতো কিছুই হয়নি। এই কারণে ভোটের পর থেকে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। মিয়ানমারে গুঞ্জন রয়েছে, ভোটের পরও সেনাবাহিনী সু চির সঙ্গে দর-কষাকষি করছিল জেনারেল মিন অং কে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু সু চি সেই আপসে যাননি। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থান।
টাটমা-ডতে এমন শঙ্কাও ছিল জেনারেল মিন অং হ্লাইং অবসরে গেলে তিনি ও অন্যান্য জেনারেলদের রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে চলমান আন্তর্জাতিক বিচারে সু চি আর সুরক্ষা না-ও দিতে পারেন। আগামী বছরই জেনারেল মিন অংয়ের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
সু চি এখন কী করবেন
সু চির সামনে এই পরিস্থিতি চরম চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ‘টাটমা-ডর বিরুদ্ধে ১৯৮৮ থেকে প্রায় দুই দশক স্থায়ী রক্তক্ষয়ী জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দেশটিতে নির্বাচনী গণতন্ত্রের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। ৭৫ বছর বয়সে এসে আবার তাঁর সামনে একই করণীয় এসে হাজির হয়েছে। আগের মতো তাঁর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমাজের সম্পর্কও ভালো নেই আর। রোহিঙ্গাবিরোধী গণহত্যা রুখতে ব্যর্থতায় বৈশ্বিকভাবে তিনি হতাশ করেছেন সবাইকে। কিন্তু তারপরও সেনা শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তাঁকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া বিশ্বসমাজের উপায় নেই। ইতিমধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সেনাবাহিনীর বর্তমান ক্যু ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ওপর নিপীড়নের নতুন তরঙ্গ তৈরি করবে। সু চিকে তাই নতুন করে জনগণকে গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে আহ্বান করা ছাড়া উপায় নেই। পাশাপাশি অতীত ভুলগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই আন্তর্জাতিক সমাজের কাছেও তাঁকে সহায়তার আহ্বান জানাতে হবে এই মুহূর্তে।
মিয়ানমারের জন্য আত্মঘাতী অধ্যায়ের পেছনে চীনের ইন্ধন রয়েছে বলে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোর সবার ধারণা। সেনাবাহিনী যে কারণে সু চির হাত থেকে ক্ষমতা ছিনতাই করেছে—চীনও একই কারণে তাতে সমর্থন দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চীন এখনো নীরব!
মিয়ানমারে নাটকীয় কিছু ঘটলেই সবাই চীনের মতামত জানতে উদ্গ্রীব থাকে। সর্বশেষ ক্যু নিয়ে চীন এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। চীনের সরকার-সমর্থক গ্লোবাল টাইমসে অভ্যুত্থানের সংবাদ এসেছে অভ্যুত্থানকারীদের বক্তব্যসহ। তবে টাটমা-ডর চলতি দুঃসাহসী এবং মিয়ানমারের জন্য আত্মঘাতী অধ্যায়ের পেছনে চীনের ইন্ধন রয়েছে বলে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোর সবার ধারণা। সেনাবাহিনী যে কারণে সু চির হাত থেকে ক্ষমতা ছিনতাই করেছে—চীনও একই কারণে তাতে সমর্থন দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনের শিকড় বিস্তার দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রভাব বাড়াতে পারে বলে চীনের বিশেষ ভীতি ছিল। চীনের কাছে মিয়ানমারের ভূকৌশলগত গুরুত্ব উত্তর কোরিয়ার মতো। সীমান্ত লাগোয়া এই দেশগুলোতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রভাবই দেখতে চায় না এবং সেটা যেকোনো মূল্যে। কেবল সামরিক অভ্যুত্থান নয়, মিয়ানমারজুড়ে খনিজ সম্পদ লুণ্ঠন এবং জাতিগত নিপীড়নেও চীন স্থানীয় জেনারেলদের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হয়ে ছিল দশকের পর দশক ধরে। ফলে ধারণা করা, যায় জনগণের মতামতের বিরুদ্ধে চলতি সেনা আগ্রাসনেও চীনের নীরব সম্মতি রয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য খারাপ সংবাদ
বিশ্ববাসীর মতোই বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের সর্বশেষ ঘটনাবলি অত্যন্ত খারাপ এক বার্তা। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনা এই ঘটনায় বিলম্বিত হবে। আরাকানে যুদ্ধ পরিস্থিতিরও অবনতি হতে পারে একই কারণে। এমনকি আরাকান আর্মির সঙ্গে টাটমা-ডর সংঘাত বাড়তে থাকলে আরাকান থেকে আরও শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে চাইবে আসন্ন দিনগুলোতে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক