সাংসদদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত—বিষয়টি নিয়ে সুশীল সমাজসহ গণমাধ্যমে আবারও আলোচনা হচ্ছে। কিছুদিন আগে সরকারদলীয় সাংসদ গোলাম মাওলা রনির হাতে দুই সংবাদকর্মী নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর এ আলোচনা আরও জোরদার হয়েছে। এর আগেও কয়েকজন সাংসদ বিতর্কিত আচরণের জন্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। তাঁদেরই একজন কক্সবাজারের সরকারদলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি। একের পর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিয়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি খবরের শিরোনাম হয়েছেন।
সংবিধানের পঞ্চম ভাগের ৬৬ অনুচ্ছেদে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়টি নির্ধারণ করা আছে। ওই অনুচ্ছেদে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার প্রাথমিক কিছু শর্তের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরও বিশেষ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পদ খারিজ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ আছে। কিন্তু একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংসদদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলা নেই।
সংবিধানপ্রণেতাদের হয়তো বিশ্বাস ছিল, জনগণকে সেবা দিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হবেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা ‘উন্নত মানবিক’ গুণাবলির অধিকারী হবেন। তা ছাড়া সংবিধানে প্রতিটি বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উল্লেখ থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ঘটনা, অবস্থা, বাস্তবতা, মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সংবিধানে পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কার্যপ্রণালি বিধি রয়েছে। ১৯৭৩ সালে প্রণয়নের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কার্যপ্রণালি বিধি মোট ১০ বার সংশোধিত হয়েছে। ওই বিধিতে সাংসদের আচরণ কেমন হবে, সে সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। সাংসদদের আচরণ-সম্পর্কিত এসব বিধিবিধান সংসদ কার্যক্রম পরিচালনার সময় অবশ্যই পালনীয়। কার্যপ্রণালি বিধির ২৬৭ অনুচ্ছেদে ‘সদস্যবৃন্দ কর্তৃক পালনীয় বিধি’ উল্লেখ করা হয়েছে। ২৬৭ অনুচ্ছেদের ২ দফায় বলা হয়েছে, ‘কোন সদস্য বক্তৃতাকালে তাঁহাকে উচ্ছৃঙ্খল উক্তি বা গোলমাল সৃষ্টি বা অন্য কোনরূপ আচরণ দ্বারা বাধা প্রদান করিবেন না।’
৯ দফায় বলা হয়েছে, ‘সংসদের কাজে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবেন না এবং বক্তৃতা চলাকালে কোন প্রকার টিকা-টিপ্পনী কাটিবেন না, শিস্ দিবেন না।’
২৭০ অনুচ্ছেদের ৬ দফায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সদস্য বক্তৃতাকালে, কোনো আক্রমণাত্মক, কটু বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করিবেন না।’
কার্যপ্রণালি বিধির চতুর্থ অধ্যায়ে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এর ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘স্পীকারের বিবেচনামতে কোন সদস্য গুরুতর বিশৃঙ্খল আচরণ করিলে স্পীকার তাঁহাকে অবিলম্বে সংসদ হইতে চলিয়া যাইতে আদেশ দান করিতে পারিবেন এবং এইরূপে আদিষ্ট হইবামাত্র সংশ্লিষ্ট সদস্য সংসদ হইতে চলিয়া যাইবেন এবং সেই দিনের {বৈঠকে স্পীকার কর্তৃক নির্ধারিত}সময়ের জন্য অনুপস্থিত থাকিবেন।’
তবে সংসদের বাইরে তাঁদের আচরণ ও দায়দায়িত্ব কেমন হবে, কার্যপ্রণালি বিধিতে তা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই সাংসদদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি (কোড অব কনডাক্ট) রয়েছে। ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্স, ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভা, কানাডার পার্লামেন্ট এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে সাংসদদের জন্য আচরণবিধি রয়েছে।
তবে দেরিতে হলেও সাংসদদের আচরণ-সম্পর্কিত একটি বিল নবম সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বিলটি অবশ্য সরকারের তরফ থেকে উত্থাপিত হয়নি। বেসরকারি বিল হিসেবে সরকারদলীয় সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী ২০১০ সালে এটি উত্থাপন করেন। এর পর অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ওই বিল বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব-সম্পর্কিত কমিটিতে প্রেরণ করে সংসদ। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১১ সালের মার্চ মাসে ‘সংসদ-সদস্য আচরণ বিল, ২০১০’ শিরোনামের বিলটি পাসের জন্য সংসদের কাছে সুপারিশ করে কমিটি। বিলটি সংশোধিত আকারে সংসদে পেশের আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমীর-উল ইসলামের মতামত ও পরামর্শ নেয় কমিটি।
বিলটি উত্থাপনের সময় সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী এর উদ্দেশ্য ও কারণসংবলিত বিবৃতির শুরুতেই উল্লেখ করেছেন, ‘সংসদ-সদস্যগণ নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি অবিচল থাকিয়া যাহাতে তাঁহাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ও আচরণে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটাইতে সক্ষম হন, সেই লক্ষ্যে এ বিল প্রস্তাব করা হইয়াছে।’
বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব-সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরু এই বিল পাসের সুপারিশ করে সংসদে দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘জনগণ তাঁদের প্রতিনিধিদের কাছে দেশের উন্নয়ন ও ভাল আচরণ প্রত্যাশা করে।’
সুপারিশ আকারে সংসদে জমা দেওয়া আচরণবিধি বিলে সংসদ সদস্যগণের ‘নৈতিক অবস্থান’ শিরোনামের একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এতে সাংসদদের নৈতিক চরিত্র কেমন হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদের ‘ক’ দফায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সংসদ সদস্য মানবিকতা ও অনুকরণীয় চারিত্রিক গুণাবলিসম্পন্ন হবেন। ‘চ’ দফায় বলা হয়েছে, ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সকল প্রকার সমাজবিরোধী অপরাধমূলক কার্যকলাপ হইতে মুক্ত থাকিবেন সাংসদ।’
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর আড়াই বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও ‘সংসদ-সদস্য আচরণ বিল, ২০১০’ এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশন শুরু হচ্ছে এই সপ্তাহে। শেষ পর্যন্ত এই বিলটির ভাগ্যে কী ঘটছে, তা জানতে আমাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
ইমাম হোসেন সাঈদ: সাংবাদিক।