ধরা যাক, দুর্ভিক্ষ চলছে। মানুষ খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে। আপনার কাছে ১০০ বেলার খাবার আছে। যদি প্রশ্ন করা হয়: আপনি ৫০ জনকে দুই বেলা খাওয়াবেন, নাকি ১০০ জনকে এক বেলা খাওয়াবেন? সবার উত্তর আশা করি একই রকম হবে: চেষ্টা করতে হবে যত বেশিসংখ্যক মানুষকে বাঁচানো যায়। কিন্তু এখন যদি বিবেচনাটি হয়, মহামারিকালে আপনার হাতে থাকা এক কোটি টিকা আপনি দুই ডোজ করে ৫০ লাখ মানুষকে দেবেন, নাকি এক ডোজ করে দিয়ে এক কোটি মানুষের জীবন বাঁচাবেন? এখানে সম্ভবত আমরা একমত হতে পারব না। কেউ কেউ বলবেন, ‘এক ডোজ কোনো কাজে লাগবে না, এক কোটি মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে কাউকেই রক্ষা করা যাবে না।’
কিন্তু বিজ্ঞান সে কথা বলছে না। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ফাইজার ও মডার্নার এক ডোজ টিকা ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ক্ষেত্রেও এই হার ৬৪ শতাংশের ওপরে। পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে না পারলেও মারাত্মক অসুস্থতা ও জীবনহানি, এসব টিকার একটি ডোজই ঠেকিয়ে দিতে পারে। এরপরও যাঁরা সর্বজনীন এক ডোজের পক্ষে মত দেবেন না, তাঁরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, আমার প্রথম প্রশ্নেও তাঁরা আসলে ৫০ জন নির্বাচিত ব্যক্তিকেই দুবেলা খাওয়ানোর পক্ষে ছিলেন। এমনকি এ সংখ্যাকে ২৫ জনে নামিয়ে এনে, নিজেদের জন্য আরও দুবেলার খাওয়া জমিয়ে রাখার ব্যাপারেও তাঁদের লোভ থেকে থাকতে পারে!
সারা পৃথিবীতে সুবিধাভোগীরা দুই ডোজ টিকার পক্ষে এখন কিছু অবৈজ্ঞানিক যুক্তিও হাজির করছেন। যেমন তাঁরা বলছেন, ‘দুই ডোজ দিয়ে পুরোপুরি ভ্যাকসিনেটেড করা না গেলে সংক্রমণ চক্র কিছুতেই ভাঙা যাবে না। হাফ ভ্যাকসিনেটেড মানুষ বরং নতুন ভেরিয়েন্টের জন্ম দিতে পারে!’ এসব বক্তব্য আসছে সেই বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে, যাঁরা প্রথমেই মহামারিটিকে ‘মেডিকেল ক্রাইসিস’ বানিয়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করেছেন। আইসিইউ-ভেন্টিলেটর জপতে জপতে সরকারের মাথা খারাপ করে দিলেন, কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় কেবল ‘অক্সিজেন থেরাপি’ নিশ্চিত করেই যে পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দেওয়া যায়, সেদিকে তাঁরা এতটুকু নজর দিলেন না!
পর্যাপ্ত ‘নেগেটিভ প্রেশার’ অবকাঠামো না থাকায়, শুধু নিজেদের ঝুঁকি বিবেচনায়, তাঁরা বহুদিন পর্যন্ত ‘হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা’ ব্যবহার পর্যন্ত করতে দেননি, যা সে সময় বহু মানুষের জীবনহানির কারণ হয়েছে। এখন অবশ্য সবখানেই সবচেয়ে বড় এ প্রতিকার কাজে লাগানো হচ্ছে। এপিডেমিওলজিস্ট ও ভাইরোলজিস্টরা বিষয়টি কমবেশি বোঝেন, তবে টিকাকে তাঁরা রীতিমতো ‘হোলি গ্রেইল’ জ্ঞান করে বসে আছেন! টিকার কার্যকারিতা নিয়ে এতটুকু কথা উঠতে পারে—এমন কোনো নতুন চিন্তা তাঁরা মাথায়ও আনতে রাজি নন। তাই যত কমসংখ্যক মানুষকেই দেওয়া যাক না কেন, আক্ষরিক অর্থে দুই ডোজের পক্ষেই তাঁরা অনড়!
কিন্তু ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি না বুঝে এবং তাদের বিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবেচনায় না নিয়ে কেবল টিকা টিকা করলে একটা সময় ব্রিজ ডাঙায় পড়ে থাকবে, নদী সরে যাবে অন্যদিকে। ভাইরাসটি যদি বিবর্তিত হতে হতে ‘ভ্যাকসিন স্কেপ’ ভেরিয়েন্ট জন্ম দিয়ে ফেলে, তাহলে তাদের এ টিকা আর কোনো কাজে লাগবে না, কেননা তখন তারা দুই ডোজের বাধাকেও অতিক্রম করে যাবে। অন্যদিকে, এক ডোজের অর্ধেক প্রতিবন্ধকতা যে দুই ডোজের পূর্ণাঙ্গ বাধার চেয়ে ভাইরাসটির ওপর কম ‘সিলেকশন প্রেশার’ কিংবা ‘বদলে যাওয়ার চাপ’ সৃষ্টি করবে, সেটা বুঝতে নিশ্চয়ই বিবর্তনবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সবাইকে একটি করে ডোজ দেওয়া হলে সামগ্রিক ‘ভাইরাল লোড’ ও মিউটেশনের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাওয়ায় নতুন ভেরিয়েন্ট আত্মপ্রকাশের সুযোগও দুই ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। উল্টো দিকে কেবল অর্ধেকসংখ্যক মানুষকে দুই ডোজ করে টিকা দেওয়া হলে বিদ্যমান সম্পূর্ণ ‘ভাইরাল লোড’ অরক্ষিত বাকি অর্ধেক জনগোষ্ঠীর ওপর দ্বিগুণ হারে গিয়ে পড়বে এবং নন-ভ্যাকসিনেটেডদের মধ্যে অবাধ রিপ্রোডাকশন ও মিউটেশনের ফলে নতুন ভেরিয়েন্ট উদ্ভবের আশঙ্কা ‘সর্বজনীন এক ডোজ’ কৌশলের চেয়ে চার গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে।
ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তার ইভল্যুশনারি পথ ধরেই হাঁটতে হবে। প্রথমে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে কমবেশি ৫০ শতাংশ অ্যাফিকেসির এক ডোজ টিকা দিয়ে প্রাণহানি রোধের পাশাপাশি মধ্যম মানের একটি সামগ্রিক সুরক্ষাবলয় তৈরি করে ভাইরাসের সঙ্গে একধরনের সহাবস্থানের সন্ধিতে পৌঁছতে হবে। যেখানে তার বংশবিস্তারে পুরোপুরি বাধা না দিয়ে নতুন আরও সংক্রমণশীল ভেরিয়েন্টের ‘নিশ’ কিংবা ‘চাহিদা’ অনেকখানিই কমিয়ে দেওয়া সম্ভব।
কেবল সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবেও নন-ভ্যাকসিনেটেড একজন আক্রান্ত ব্যক্তির ‘ভাইরাল লোড’, এক ডোজ দেওয়া দুজন সংক্রমিত ব্যক্তির চেয়েও দুই গুণ বেশি । কেবল এ বিবেচনাতেই এক ডোজ দিয়ে দ্বিগুণসংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের পক্ষে আমাদের সবার সোচ্চার হওয়া উচিত। কেননা, তাতে গোটা জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক ‘ভাইরাল লোড’ যেমন কমবে, তেমনি ‘বেসিক রিপ্রোডাকশন রেশিও’ও দ্রুত নিম্নগামী হতে থাকবে।
ধরে নেওয়া যাক, একটি জনগোষ্ঠীর সবাইকে একটি করে ডোজ দিয়ে ‘হাফ ভ্যাকসিনেটেড’ করা হলো; তাতে হিসাবমতো অর্ধেক মানুষের তখনো আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাদের ‘ভাইরাল লোড’ হবে কেবল অর্ধেক এবং তারা যাদের সংক্রমিত করবে, তাদের কাছে স্থানান্তরিতও হবে অর্ধেক মাত্র ভাইরাস। আর সংক্রমণ রোধের ‘অর্ধেক সক্ষমতা’ তো সমগ্র জনগোষ্ঠীকে এক ডোজ টিকা আগেই দিয়ে রেখেছে, যা অর্ধেক শক্তির সংক্রমণকে সেখানেই ঠেকিয়ে দিতে পারবে! ফলে, সবাইকে এক ডোজ টিকা দেওয়ার মাত্র এক ‘ল্যাপ’ অর্থাৎ ১৪ দিন পরেই ভাইরাসটির ‘সংক্রমণ চক্র’ ভেঙে পড়তে শুরু করবে।
সর্বজনীন এক ডোজের যৌক্তিকতা নিয়ে এত দিন কেবল বিবর্তনবিজ্ঞানীরা গলা ফাটিয়েছেন, সম্প্রতি রোগতাত্ত্বিকেরাও কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁরা এখন, টিকাস্বল্পতা বিবেচনায় সারা পৃথিবীতে ‘ডোজ স্পেয়ারিং’ করার প্রস্তাব তুলেছেন। স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টিকা-বৈষম্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন! বিশ্বের ৭৯০ কোটি মানুষকে যত শিগগিরই সম্ভব এক ডোজ করে টিকা দেওয়া গেলেই কেবল করোনা মহামারির রাশ টেনে ধরা সম্ভব, অন্য কোনোভাবে নয়।
মোজাম্মেল বাবু এডিটরস গিল্ডের সভাপতি ও একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক