পুঁজির মালিককে আরও পুঁজি আহরণে তাড়িত করে—কার্ল মার্ক্সের এই তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজাতির সামষ্টিক সুখের জন্য সম্পদের মালিকানার গুরুত্ব। বস্তুত সম্পদের মালিকানা কার হাতে থাকবে, তাই মানবজাতির সামষ্টিক সুখের নির্ণায়ক। সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির হাতে থাকলে উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানাও ব্যক্তির হাতে থাকবে, বাজার থাকবে, মুনাফা থাকবে, শ্রমের কেনাবেচা হবে, বাজারের মধ্যেই মজুরি নির্ধারিত হবে, সম্পদের মেরুকরণ হবে অর্থাৎ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সিংহভাগ সম্পদ চলে যাবে। কিছু মানুষ সম্পদহীন হয়ে যাবে এবং তাঁর শেষ সম্বল, মজুরি বিক্রি করতে পারলে খাবার জুটবে আর বিক্রি না করতে পারলে খাবার জুটবে না। সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা ব্যক্তির হাতে রেখে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে, সেখানে রাষ্ট্র ব্যক্তির কোনো দায়িত্ব নেয় না।
কমিউনিস্ট ব্যবস্থার ওপর গড়ে ওঠা প্রথম রাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নে আসলে কী ঘটেছিল, সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই তা একটি গভীর আগ্রহের বিষয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায় যে সেখানে ব্যক্তিমালিকানা রহিত করে রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল বটে; কিন্তু সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্রে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলেও সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না-ও হতে পারে। রাষ্ট্রের মালিকানা ও সামাজিক মালিকানা—এ দুইয়ে বিস্তর ব্যবধান।
মালিকানা যদি শুধু রাষ্ট্রের হয়, তাহলে তা যান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে অর্থাৎ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা থাকলে তাতে সমাজের প্রতিটি মানুষ একাত্ম না-ও হতে পারে। এই ব্যবস্থার মধ্যে সমাজের প্রতিটি মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন না-ও ঘটতে পারে, তাঁদের রুচি ও পছন্দের প্রতিফলন না-ও ঘটতে পারে, নিজের ইচ্ছেমতো জীবন পরিচালনের, নিজের মতো করে সৃষ্টিশীল হওয়ার ও অবদান রাখার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। এই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়নে মানুষের সুখ সর্বাধিক করা সম্ভব হয়নি এবং সেই অসন্তোষ থেকেই ধীরে ধীরে ব্যবস্থাটি পতনের দিকে এগিয়ে গেছে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজির মালিক সর্বগ্রাসী। করোনাসৃষ্ট মহামারি অবস্থার মধ্যেও ২০২০ সালে পুঁজিপতিরা কীভাবে সম্পদ আহরণ করছেন, তার একটা চিত্র এখানে উপস্থাপন করা যাক। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমেরিকাতে সাড়ে চার কোটি লোক বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। এই একই সময়সীমায় আমেরিকার বিলিয়নিয়ার সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস কামিয়েছেন ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর ফেসবুক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জেফ বেজোস জুলাইয়ের এক দিনেই আয় করেছেন ১৩ বিলিয়ন ডলার। মহামারির এই ভয়াবহ মহামন্দার মধ্যেও ২০২০ সালেই তাঁর সম্পদ ৭৪ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ১৮৯.৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
একই সময়ে ফেসবুকপ্রধান জাকারবার্গের সম্পদ বেড়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। এত লাভের পরও মহামারিতে ঝুঁকির মধ্যে কাজ করার জন্য কর্মীদের প্রতি ঘণ্টায় যে ২ ডলার করে বেশি দেওয়া হতো, আগামী মে মাসে তা থেকেও সরে যাচ্ছে আমাজন। যদিও ২০২১ শেষ হওয়ার আগে মহামারি অবসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। এসব উদাহরণ কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বে বিবৃত পুঁজির চারিত্র্যই সত্য প্রমাণ করে।
আমেরিকান ফেডারেল গভর্নমেন্ট মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে একচেটিয়া কারবারের অভিযোগ তুলে ৯০-এর দশকের শেষ দিকে অ্যান্টি-ট্রাস্ট মামলা করেছিল, অথচ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস একজন ফিলানথ্রোপিস্ট তথা মানবহিতৈষী হিসেবে পরিচিত। একই ধরনের অভিযোগ ফেসবুক, অ্যাপল, আমাজন ও গুগলের বিরুদ্ধেও তুলেছে আমেরিকান গভর্নমেন্ট। এখানে যেটা উল্লেখযোগ্য, আমেরিকা একটি পুঁজিবাদী দেশ, যা মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে; অন্যদিকে যেসব কোম্পানির কথা বলা হলো তাদের কর্তাব্যক্তিরা কোনো না কোনোভাবে মানবহিতৈষীর তকমা লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। তারপরও কোম্পানিগুলো মুনাফার জন্য এতটাই মরিয়া যে মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ হয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে এদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়েছে। কারণ, কোম্পানিগুলো লাগামহীন মুনাফা করার লক্ষ্যে বাজার ও সমাজের যে ক্ষতি করছিল, তা সহনীয় পর্যায়েও ছিল না।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা সামাজিক না হলে প্রতিযোগিতা থাকবে এবং অধিক মুনাফার লোভে পরিবেশের ক্ষতি করে হলেও তারা পণ্য উৎপাদন করবে। এটাই পুঁজির চরিত্র। সে জন্যই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে থাকবেন, পরিবেশ ধ্বংস করে মুনাফা অর্জন করলেও বাধা দেবে না—এমন দলকে, এমন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় আনতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন।
পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ। সম্পদে যখন ব্যক্তিমালিকানা থাকে, তখন মুনাফার জন্য সবাই প্রতিযোগিতায় নামে। কারণ, প্রতিযোগিতা ব্যক্তিমালিকানার অপরিহার্য শর্ত। একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যদি পরিবেশের ক্ষতির বিনিময়ে তার পণ্য উৎপাদন করে, অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও একই কাজ করতে হবে। না হলে সে ব্যবসা টিকে থাকতে পারবে না। কারণ, পরিবেশের ক্ষতির বিনিময়ে যে প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন করল, সে যতটা সস্তায় পণ্যটা দিতে পারবে, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তা দিতে পারবে না। ফলে অন্যদের ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারের বেলায় যে দেশে পরিবেশের ক্ষতির বিনিময়ে পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব, সেই দেশের কোম্পানিগুলো সস্তায় পণ্য সরবরাহ করতে পারবে এবং তারাই বাজার দখল করবে। উদাহরণস্বরূপ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে আমেরিকান কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের তুলনায় প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিল, কারণ ট্রাম্প পরিবেশ রক্ষার প্যারিস চুক্তিতে সই করেননি, কিন্তু ইউরোপ করেছে। অর্থাৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা সামাজিক না হলে প্রতিযোগিতা থাকবে এবং অধিক মুনাফার লোভে পরিবেশের ক্ষতি করে হলেও তারা পণ্য উৎপাদন করবে। এটাই পুঁজির চরিত্র। সে জন্যই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে থাকবেন, পরিবেশ ধ্বংস করে মুনাফা অর্জন করলেও বাধা দেবে না—এমন দলকে, এমন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় আনতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন।
অনেক বহুজাতিক কোম্পানি নিজেদের পণ্য বাজারে যথেচ্ছ বিক্রির লক্ষ্যে ভাড়া করা বিজ্ঞানী দিয়ে গবেষণা করিয়ে পণ্যের নেতিবাচক দিক ঢেকে গুণ অতিরঞ্জিত করার ঘটনা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অনেক ঘটনা আমরা জানি, যেখানে ক্যানসার না হলেও কেমোথেরাপি দিয়ে রোগীর কাছ থেকে টাকা আদায়, নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হলেও প্রসূতিকে সিজারিয়ানে বাধ্য করিয়ে আয় বাড়ানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে উদাহরণগুলো এখানে দেওয়া হলো, তাতে মানুষের মৃত্যুঝুঁকি থাকলেও ব্যক্তিমালিকানা, প্রতিযোগিতা ও মুনাফার চক্র থেকে সমাজ রক্ষা পাচ্ছে না।
২০২০-এর মহামারি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে গেল, ধনী-গরিবনির্বিশেষে সমাজের একজন মানুষও যদি করোনা থেকে অরক্ষিত থাকে, তাহলে সমাজের অন্য সবাই-ই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ সমাজের সব মানুষকে টিকা দিয়ে সুরক্ষিত করা আমার নিজের স্বার্থেই জরুরি। না হলে আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। এই যে চেতনা, এর নাম হলো সমন্বিত জীবনচেতনা তথা স্পিরিট অব কালেকটিভ লাইফ। এ ছাড়া মানবজাতির সুখ সর্বাধিক করা অসম্ভব, ওপরের উদাহরণগুলোও এ কথাই প্রমাণ করে। আর সম্পদের সামাজিক মালিকানা ছাড়া সমন্বিত জীবনচেতনা সৃষ্টি করা যাবে না।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো প্রফিট-মোটিভ। কমিউনিস্ট অর্থনীতির চালিকা শক্তি তাহলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর মাও জেদং একটি উদাহরণ সহকারে দিয়েছেন, ‘নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে আপনার নৌকাটি আপনাআপনিই ওপরে উঠে যাবে। একজন মাঝির পক্ষে নিজের নৌকাটি একা একা ওপরে ওঠানো সম্ভব নয়। অতএব, সবাই মিলে একত্রে নদীর পানি বৃদ্ধি করতে হবে।’ এই উপমার মধ্য দিয়ে মাও জেদং আসলে সমন্বিত জীবনচেতনার কথাই বলছেন। প্রফিট-মোটিভের বিপরীতে কমিউনিস্ট অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে সমন্বিত জীবনচেতনাকেই তিনি ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন।
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর এট লার্জ।