কোরবানির ঈদে ট্রাকে, নৌকায় গাদাগাদি করে অত্যন্ত নির্মমভাবে পশু পরিবহনের দৃশ্য আমরা নিত্যই দেখি। এখন ট্রাকে করে শ্রমিক বহনের দৃশ্যও আমরা দেখছি। পোশাক কারখানা খোলার হঠাৎ ঘোষণা শুনে ট্রাকে করে নিরুপায় শ্রমিক ও কর্মকর্তারা রাজধানীতে ফিরেছেন। কয়েক দফা ট্রাক পরিবর্তন করেছেন। ট্রাক ছাড়াও মোটরসাইকেল, রিকশা ও পায়ে হেঁটে শ্রমিকেরা কর্মস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বৃহস্পতি ও শুক্রবার দিনভর লাখো শ্রমিকের ভোগান্তির পর শনিবার সন্ধ্যায় সরকারের তরফে ঘোষণা আসে, শ্রমিকদের বহনের জন্য রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাস ও লঞ্চ চলাচল করবে। এর মধ্যে শ্রমিকদের যা ভোগান্তি হয়েছে, তার বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা দেশের মানুষ এই ভোগান্তির তথ্য পেয়েছেন ও দেখেছেন।
সরকার কারখানা খোলার ঘোষণা দিলেও শ্রমিক পরিবহনের বিষয়ে কিছু বলেনি। সরকারের হিতাহিতজ্ঞানশূন্য এ ধরনের ঘোষণায় শ্রমিকেরা ট্রাকে, নৌকায় গাদাগাদি করে বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়েছেন। করোনাকালে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। অথচ নদীর ফেরিগুলোতে তিলধারণের জায়গা ছিল না। এ পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা ঘনীভূত হয়। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এসব জানেন নিশ্চয়ই। এরপরও এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই। সরকারের ঠিক কোন অংশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করেন, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। যদি রাজনীতিবিদদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা থাকে, তবে বলতে হবে, তাঁদের বিন্দুমাত্র বাস্তব ধারণা নেই করোনার পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে। আর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমলাদের অপরিপক্ব জ্ঞান ও অদক্ষতার পরিচয় মেলে। আর পোশাক কারখানার মালিকেরা সরকারকে প্ররোচিত করলে বুঝতে হবে, তাঁদের এখনো হুঁশ ফেরেনি। অর্থের লোভে শ্রমিকদের বলি দিতেও পিছপা হচ্ছেন না।
পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া খুবই জরুরি হলে আরও পরিকল্পিতভাবে কয়েক ধাপে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যেত। কিন্তু বারবার শ্রমিকদের নিয়ে ছেলেখেলা করা হচ্ছে। এর আগেও শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে, কোলে করে কর্মস্থলে ফিরেছেন। করোনার মহামারিতে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা এমনিতেই শোচনীয়। তাই যেকোনো মূল্যে শ্রমিকেরা কর্মস্থলে ফিরতে চান। কোনোভাবেই চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে চান না।
ঘোষণা ছিল ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিশেষ বিধিনিষেধ বহাল থাকবে। এ বিধিনিষেধের আওতায় পোশাক কারখানাও বন্ধ থাকবে। তাহলে কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এল কেন? এর সঙ্গে শুক্রবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে। বাংলাদেশকে হটিয়ে বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। অনেক দিন ধরেই ভিয়েতনাম আমাদের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছিল। করোনার সময় আমাদের অপরিকল্পিত ও অপরিপক্ব চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্তের কারণে ভিয়েতনাম ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
সম্ভবত ভিয়েতনামের কাছে অবস্থান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে তড়িঘড়ি করে পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হয়েছে। কিন্তু যে অবস্থায় ও যেভাবে পোশাক কারখানা চালু রাখা হচ্ছে, তাতে পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে ক্ষুণ্ন হতে পারে।
শুরু থেকেই আমাদের করোনা মোকাবিলায় সুচিন্তার ছাপ স্পষ্ট ছিল না। একধরনের লুকোছাপা ও হতোদ্যম অবস্থা লক্ষ করা যায়। আমাদের সম্পদ সীমিত। চাইলেই আমরা উন্নত বিশ্বের মতো উদ্যোগ নিতে পারব না। বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার সহজ ও সরল পরিকল্পনা নেওয়া উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকা করে কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল ও স্থগিত করে স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ করতে পারত সরকার। সর্বশেষ বাজেটে পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য কিছু বরাদ্দ করা হয়েছে। সারা বিশ্বেই এখন পর্যটনের মন্দা অবস্থা। এ অবস্থায় পর্যটন খাতে অর্থ ঢেলে খুব ফল পাওয়া যাবে না। এই অর্থ দিয়ে বরং জেলা সদরগুলোতে করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করা যেত।
এসবের পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ পোশাক খাতকে সচল রাখার জন্য শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি ছিল। তাহলে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে আমাদের পোশাক খাত সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে যেত। কিন্তু ভিয়েতনামের কাছে অবস্থান হারানোর পর তড়িঘড়ি কারখানা খোলার ফলে বরং নেতিবাচক বার্তা যাবে ক্রেতাদের কাছে। গত কয়েক দিনে শ্রমিকদের ভোগান্তির তথ্য নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। আরও হবে। বৈশ্বিক পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন, শ্রমিকদের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে আমাদের এখানে। এতে করে ক্রেতাদের মন ঘুরে যেতে পারে এবং শ্রমিকদের নিরাপদ জায়গার জন্য বিকল্প জায়গার অনুসন্ধান করতে পারে।
শুরু থেকেই করোনা মোকাবিলায় আমাদের হযবরল অবস্থা ছিল। আর ওদিকে ভিয়েতনাম পরিকল্পিতভাবে করোনা মোকাবিলা করেছে। যথাযথভাবে লকডাউন কার্যকর করেছে। ভিয়েতনাম টিকা কূটনীতিতে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। করোনা মোকাবিলায় ভিয়েতনাম মডেল সারা বিশ্বেই আলোচিত হচ্ছে। ভিয়েতনাম সুপরিকল্পনার সুফল পেয়েছে। সংকটকালেও তারা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা নিশ্চয়ই এ অবস্থান ধরে রাখতে চাইবে। আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চাইবে। ক্রেতারাও নিরাপদ বিবেচনা করে ভিয়েতনামে যেতে চাইবে ক্রয়াদেশ নিয়ে। পদ্মা নদীর ফেরিতে গাদাগাদি করে পোশাকশ্রমিকদের কর্মস্থলে ফিরে আসার দৃশ্য তাদের খুব বেশি উৎসাহিত না-ও করতে পারে।
অবশ্য পোশাক কারখানার মালিক সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ক্রয়াদেশ আগের থেকে বেড়েছে। এটা খুবই ভালো সংবাদ। যদি ক্রয়াদেশ বৃদ্ধিই পায়, তবে শ্রমিকদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে মহামারির সময়। প্রতিটি ক্রয়াদেশ থেকে লাভের ৫ বা ১০ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। কারণ, শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পোশাকশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন এই মহামারির সময়ে। তাঁদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ঘোষণা করা জরুরি।
কিন্তু এমন হওয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। বরং বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো ঘটনা। গত বছর মহামারি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছিল পোশাক খাতের জন্য। এই অর্থ দিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার কথা ছিল। বেতন দিয়েছে, কিন্তু ৪০ শতাংশ মালিকেরা কেটে রেখেছেন। এবারের ঈদেও অনেক কারখানার শ্রমিকেরা বেতন ও বোনাস পাননি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সব দায় শ্রমিকদের। দেশের রপ্তানি আয় ধরে রাখতে, ভিয়েতনামের কাছে হারানো অবস্থান উদ্ধার করতে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, কোলে, কাঁখে, কাঁধে চড়ে হলেও কর্মস্থলে আসতে হবে। যেকোনো মূল্যে কারখানার মেশিন চালু রাখতে হবে। কিন্তু শ্রমিকের জীবনের মেশিন তো আর চলছে না। এক জায়গাতেই থমকে আছে। এই পরিস্থিতির অবসানের জন্য সমস্বরে আওয়াজ তোলা প্রয়োজন। পোশাকশিল্পে অর্জিত আয়ে শ্রমিকদেরও ভাগ আছে। তাঁদের সেই হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। শ্রমিকদের লভ্যাংশ নিশ্চিতের দাবি করার এখনই সময়। শ্রমিকেরা পশু নন। মানুষ। তাঁদের নিয়ে তামাশা করা বন্ধ করতে হবে যেকোনো মূল্যে।
মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক