চিত্রশিল্পী ও শিল্প-সংগঠক সুবীর চৌধুরীর অকালপ্রয়াণে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জগৎ এখন শোকসন্তপ্ত। সুবীরকে যাঁরা ভালোবাসেন, যাঁরা তাঁর শিল্পোদ্যোগ কর্মকাণ্ডের অনুরাগী, তাঁর সান্নিধ্যে ছিলেন যাঁরা, তাঁরা কেউ ভাবতে পারেননি মাত্র ৬১ বছর বয়সে সুবীর চলে যাবেন।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমে ক্যানবেরায় ও পরে সিডনির হাসপাতালে সুবীরের চিকিৎসার সময় তাঁর সঙ্গে ওয়াশিংটন থেকে প্রায়ই টেলিফোনে কথা হয়েছে আমার এবং প্রতিবারই সুবীর আমাকে জানিয়েছেন, তাঁর অবস্থা ভালোর দিকে। তবে শেষের দিকে তাঁর কণ্ঠ বেশ দুর্বল ছিল।
উদ্বেগ-আশঙ্কা নিয়ে ঢাকায় সুবীরের বড় শুভানুধ্যায়ী বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, সুবীরের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন তাঁর মস্তিষ্কের টিউমার ছোট হয়ে আসছে এবং তাঁর অবস্থা ভালোর দিকে। তা ছাড়া, শিগগিরই তাঁকে সিডনি থেকে সিঙ্গাপুরে আনা হবে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য। শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।
সুবীর চৌধুরীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কাইয়ুম ভাই বছর দশেক আগে ঢাকায়। তারপর যতবার ওয়াশিংটন থেকে ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছি, প্রতিবারই কাইয়ুম ভাই আমাকে নিয়ে গিয়েছেন বেঙ্গল শিল্পাঙ্গনে এবং সেখানে মুগ্ধ হয়েছি সুবীরের আতিথেয়তায়। গত বছর ডিসেম্বর মাসে আমার ঢাকা সফরকালে অবরোধ-হরতাল চলেছে দিনের পর দিন। সে সময় রাস্তায় কেউ গাড়ি চালাতে সাহস করত না বোমা হামলা-ভাঙচুরের ভয়ে। ফলে ঢাকায় দিনগুলো ছিল একরকম বন্দিজীবন। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন সুবীর চৌধুরী। সাহস করে এবং ঝুঁকি নিয়ে তিনি গাড়ি পাঠিয়েছেন এবং সেই গাড়িতে করে আজিমপুর থেকে কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছি বেঙ্গল শিল্পাঙ্গনের নানা অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া, সে সময় ঢাকায় বিমানবন্দরের কাছে আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তিন রাত ধরে যে উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, তার আনন্দ উপভোগ সম্ভব হয়েছে সুবীরের কল্যাণে।
সুবীরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা গত জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে ঢাকা থেকে আমার আমেরিকায় চলে আসার আগের দিন। সেদিন সন্ধ্যায় সুবীর আর সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত কাইয়ুম ভাই আর আমাকে আপ্যায়ন করেছিলেন ঢাকা ক্লাবে। সুবীরকে তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওয়াশিংটনে আসছেন তো জুলাই-আগস্টে চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে? তিনি বলেছিলেন, ‘যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’
এর আগে গত বছর সুবীর চৌধুরী ওয়াশিংটনে এসেছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আমার স্ত্রীর বড় বোন কাইয়ুমপত্নী শিল্পী তাহেরা চৌধুরী, কবি-সাংবাদিক আবুল মোমেন ও সংগীতশিল্পী শীলা মোমেনের সঙ্গে। সে সময় আমার সুযোগ হয়েছিল কয়েক দিনের জন্য সুবীরকে আমাদের বাড়িতে পাওয়ার। সুবীর তখন ওয়াশিংটনে একটি চিত্র প্রদর্শনীর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং তার জন্য আমাদের বাড়ির কাছাকাছি স্ট্র্যাথমোর ম্যানশন নামে একটি শিল্পকলা গ্যালারিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সুবীর চেয়েছিলেন এখানেই পরের বছর চিত্র প্রদর্শনী করার। ওয়াশিংটনে এই কদিন সুবীরকে আমার মনে হয়েছে আমাদের পরিবারেরই একজন। তার ওপর একদিন সকালে নাশতার টেবিলে নানা কথার মাঝে সুবীর আমাকে অনুরোধ জানালেন, যেহেতু তিনি আমার চেয়ে ২০ বছরের ছোট, সে কারণে আমি যেন তাঁকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করি। শুনে অভিভূত হয়েছিলাম।
সুবীরকে গত ১০ বছরে যতটা জেনেছি, তাতে দেখেছি তিনি স্বভাবগতভাবে কথা বলেন কম, কিন্তু কাজ করেন নীরবে-নিঃশব্দে, নিরলসভাবে। ১৯৭০-এর দশকে সুবীর ঢাকায় চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং শিল্পী হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। কিন্তু তাঁর এই সংক্ষিপ্ত জীবনের সবটাই ব্যয় করেছেন বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনকে সঞ্জীবিত এবং দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের চিত্রকলাকে পরিচিত করার কাজে।
সুবীর ১৯৭৫ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীর চিত্রকলা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে এই বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব নেন। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী জানিয়েছেন, এ সময় সুবীর একটা বড় কাজ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় দেশের চিত্রশিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্যোগ নিয়ে। এ উদ্দেশ্যে তিনি শিল্পকলা একাডেমী থেকে বাসে করে শিল্পীদের ও তাঁদের আঁকা ছবি নিয়ে বাংলাদেশের জেলায় জেলায় প্রদর্শনী করেছেন।
সুবীর চৌধুরী বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০০৪ সালে এবং পরে তিনি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও ট্রাস্টি হন। বেঙ্গল শিল্পাঙ্গনের দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র এই কয় বছরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের শিল্পীদের চিত্রকলা প্রদর্শনী ও ওয়ার্কশপ করেন বিশ্বের ১০টির বেশি দেশে। এ সময় তিনি দেশের প্রবীণ ও নবীন শিল্পীদের এবং তাঁদের আঁকা ছবি নিয়ে যান মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, কানাডা আর ইতালির রোম, ভেনিস, ফ্লোরেন্সসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে। এই প্রথম বাংলাদেশের প্রতিভাধর শিল্পীদের ও তাঁদের শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সংযোগ হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনের।
এ ছাড়া সুবীর চৌধুরী উদ্যোগ নেন বাংলাদেশে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার চারুকলার দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীর। এ উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনী ও ওয়ার্কশপে যোগ দেন বিশ্বের ৩৪টি দেশের শিল্পীরা। সেই সঙ্গে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকেরাও। সবশেষে সুবীর অস্ট্রেলিয়ায় যান গত মার্চ মাসে ‘জন্মভূমির গান’ শিরোনামে বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীদের ও তাঁদের প্রদর্শনী নিয়ে। মেলবোর্ন, সিডনি ও শেষে ক্যানবেরায় প্রদর্শনী চলাকালে সুবীর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে সুবীরের মতো উদ্যোগী মানুষ বিরল। চিত্রকলা প্রদর্শনীর আয়োজন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
ঢাকা থেকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, সুবীরের অকালপ্রয়াণে দেশের শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো, তা অপূরণীয়। সুবীর বেশ কয়েকবার বলেছেন আমাকে, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে তিনি মনে করেন তাঁর অভিভাবক এবং তাঁর ও তাঁর স্ত্রী শিল্পী তাহেরা চৌধুরীর স্নেহ-ভালোবাসায় আপ্লুত তিনি। বাংলাদেশের প্রবীণ বরেণ্য শিল্পীদের সবারই স্নেহের পাত্র ছিলেন সুবীর চৌধুরী। অর্জন করেছিলেন তাঁর অনন্য শিল্পোদ্যোগের অনুরাগী ও শুভানুধ্যায়ীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সৈয়দ জিয়াউর রহমান: সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকা, বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর।