হঠাৎ অসুস্থতার কথা বলে পদত্যাগ করলেন জাপানের দীর্ঘতম মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ১৯৪৫ সাল থেকে এযাবৎকালের মধ্যে তিনি দেশটির সবচেয়ে খ্যাতনামা রাষ্ট্রনায়ক। অনেক কিছুর পাশাপাশি এই বিশ্বনেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে গলফ খেলতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। অর্থনীতিকে কিছুটা দুর্বল অবস্থায় রেখে গেলেও তিনি জাপানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী ও স্বনিয়ন্ত্রিত করে গেছেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরও তাঁরই পথ অনুসরণ করার কথা। পূর্ব এশিয়ার শান্তি এবং নীতিভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার জন্য এটা ভালো খবর।
শিনজো আবের বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা সর্বকালের মধ্যে নিচে নেমে গিয়েছিল। তাই আরেক দফা নির্বাচনে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও ছিল না। ধারাবাহিকভাবে আট বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাঁর এমন বিদায় সাবেক কালের রাজনৈতিক জীবনের প্রতিফলন। দীর্ঘকাল দলের দায়িত্বে থাকা নেতা হিসেবে তিনি জানেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবন সমাপ্তির দিকে। মারকুটে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে পরাস্ত হওয়ার চেয়ে নিজের ইচ্ছায় সসম্মানে বিদায় নেওয়াই তাই ভালো।
যৌবনকাল থেকেই আবে আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগে ভুগছেন। এর কারণে এক বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের পর ২০০৭ সালে একবার তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। সেই পদত্যাগও কঠিন রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছিল। সে জন্য ২০১২ সালে তাঁর প্রত্যাবর্তন হয়েছিল অসাধারণ। সম্প্রতি দু–দুবার হাসপাতালে যাওয়ার ঘটনা থেকে মনে হয়, তাঁর অসুস্থতা আসলেই সত্য। টোকিও অলিম্পিক পিছিয়ে আগামী গ্রীষ্মে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এটা ভাবার কারণ আছে যে তাঁর পদত্যাগের পেছনে গুরুতর রাজনৈতিক চাপ ছিল।
বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আবের জনপ্রিয়তার পতন কিছুটা বিস্ময়কর। জাপানে কোভিড–১৯–এ মৃত্যু মাত্র ১ হাজার ৩০০ আর ইউরোপ–আমেরিকার তুলনায় অর্থনৈতিক ক্ষতিও সামান্যই। কিন্তু জনগণকে ত্রুটিপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া এবং মহামারি মোকাবিলার অর্থনৈতিক–নীতি অদরদি বলে আবের সরকার সমালোচিত হয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিও জমে যায়, জনগণ নেতৃত্বের বদল দেখতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। এসবও হয়তো তাঁর সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছিল।
এর বাইরে অর্থনীতির দশা এবং জীবনযাত্রার মান নিয়েও হতাশা বাড়ছে জাপানে। আবের সরকার অর্থনীতিতে ছোটখাটো কিছু দরকারি সংস্কার করেছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা বাড়ানোয় যে গভীর সংস্কার দরকার, তা বাস্তবায়িত হয়নি। এখন জাপানের ৪০ ভাগ কর্মশক্তি স্বল্পমেয়াদি, নাজুক চুক্তিতে নিয়োজিত। এখন যদিও অনেক নারী কর্মরত, কিন্তু নেতৃত্বের অবস্থানে তাঁদের সংখ্যা নগণ্য।
আবের প্রধান ব্যর্থতা হলো ১৯৪৭ সালের সংবিধান সংস্কার করার উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে না পারা। তিনি চান সংবিধানের শান্তিবাদী ধারাগুলো বদলে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে স্বাভাবিক করে তুলতে। জাপানের জনগণ এখনো এই পরিবর্তন মানতে রাজি নয়। তা ছাড়া সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাও তিনি পাননি।
দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিও জমে যায়, জনগণ নেতৃত্বের বদল দেখতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। এসবও হয়তো তাঁর সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছিল
আবেকে জাপান ঐতিহ্যবাদী হিসেবেই মনে রাখবে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে তাঁর অনুসারীদের বলা হয় ‘নব্যরক্ষণশীল’। এই ধারা শক্তিশালী রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ এবং সবার ওপরে আরও জোরদার ও স্বনিয়ন্ত্রিত পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতির পক্ষে।
সময়ে–সময়ে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আনুগত্যের। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে জাপানের জন্য আরও স্বনিয়ন্ত্রিত ভূমিকার জন্য কাজ করেছেন—বিশেষত ব্যবসার বেলায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালে ১২ রাষ্ট্রের ট্রান্স–প্যাসিফিক পার্টনারশিপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিলে তিনিই একে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন।
আবে ভারতের সঙ্গে জাপানের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করেছেন। জাপানের নিকটতম প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়লে আবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দেন।
তলেতলে এলডিপির ভেতরে আবের উত্তরাধিকার নিয়ে সংগ্রাম চলছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বিদ্যমান দাবিদারেরা দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নরম করার পক্ষে নন। নিরাপত্তা প্রশ্নে তাঁরা বরং আরও শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি, আরও সামরিক ব্যয়, উত্তর কোরিয়ার মিসাইল হুমকির বিরুদ্ধে আগাম–আক্রমণের সক্ষমতা অর্জন অথবা সমুদ্রসীমার মধ্যে চীনা জাহাজের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আরও শক্ত পদক্ষেপ চান।
১৯৫২ সালে জাপানে আমেরিকান দখলদারি অবসানের পর কোনো প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে চাননি। কিন্তু যখন বোঝা গেল ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো নির্ভরযোগ্য ও সহযোগী নয়, তখন আবে জাপানের জন্য আরও স্বাধীন অবস্থানের জন্য মাটি তৈরি করতে লাগলেন, দুনিয়াজুড়ে অংশীদারি জাল ছড়াতে লাগলেন। আবে চলে গেলেও জাপানের এই কৌশল রয়ে যাবে।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
বিল এমোট দ্য ইকোনমিস্ট–এর সাবেক এডিটর ইন চিফ