রোহিঙ্গা প্রশ্নে বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চাই
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ—সংখ্যার বিচারে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ। সংকটটিও তাই আগের চেয়ে বড়। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর এক সঙ্গে বাস্তুচ্যুত হওয়ার নজির সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখা যায় না।
মিয়ানমারে অবস্থিত রাখাইন রাজ্যে বসবাসকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপরে নানাবিধ সহিংসতা ও নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন এর প্রধান (ইউএনএইচসিআর) পুরো বিষয়টিকে এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত শুদ্ধির প্রথাগত পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বৈশ্বিক পরিসরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপরে নিপীড়নমূলক আচরণকে পরিকল্পিত গণহত্যা হিসেবেও দেখা হয়ে আসছে।
এরই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয় যার বিষয়বস্তু ছিল, দুই দেশের সমঝোতার মাধ্যমে কোনো ধরনের সংকট ছাড়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যেন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা এই সমঝোতার কোনো বাস্তবিক প্রয়োগ এখন পর্যন্ত দেখতে পাইনি, ফলে সংকট আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। ইতিমধ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা থেকে রক্ষার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলেও আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক ভাবে দেখা হয়নি। অনিবার্যভাবেই রোহিঙ্গা সংকট আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে প্রত্যাবাসন নিয়ে ভয় কাজ করছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যদি নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করা এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বৈধ অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তাহলে যেকোনো ধরনের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ ও টেকসই হবে না। বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া হলে, আবারও তাদের একই ধরনের নিপীড়ন এবং অসমতার স্বীকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঠিক একই আশঙ্কার কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ পরিষ্কার। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পাঠানোর কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি, বরং তাদের নিরাপদে এবং স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে ।
অপরদিকে প্রায় তিন বছর হয়ে গেলেও শরণার্থীশিবিরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান একই রকম রয়েছে। এটা তাদের জন্য হতাশাজনক বিষয়। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশে নিজ সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে বড় হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য পরিচিতির সংকট তৈরি করবে। একই ধরনের পরিচিতির সংকট আমরা ‘আটকে পরা বিহারিদের’ ক্ষেত্রেও দেখি।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যদি নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করা এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বৈধ অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তাহলে যেকোনো ধরনের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ ও টেকসই হবে না। বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া হলে, আবারও তাদের একই ধরনের নিপীড়ন এবং অসমতার স্বীকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাশাপাশি এত বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর অবস্থান স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নানা ধরনের প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়াও আরও কিছু সমস্যা সংবাদমাধ্যমে এসেছে যেমন: রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বৈষয়িক টানাপোড়েনের কারণে পারস্পরিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়া; স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি পাওয়া—টেকনাফ ও উখিয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া; রোহিঙ্গাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা; অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নাগরিক সনদ ও পাসপোর্ট তৈরির তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়াও পুরো রোহিঙ্গা সংকটটিকে অনেকেই আঞ্চলিক নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসেবেও দেখে থাকেন। এটা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি ঘটাচ্ছে।
এ সকল সমস্যার পাশাপাশি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই কোনো পদক্ষেপ নেওয়াও বেশ সমস্যাজনক। এসব তাদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। উপরন্তু বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে কত দিন এ ধরনের সংকটকে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশ নিজেই নানাবিধ উন্নয়ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞের মতামত হলো, যদি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে বোঝা না ভেবে তাদের দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা যায়; তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদে পরিকল্পনার (স্বল্পমেয়াদি থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি) মাধ্যমে টেকসই শরণার্থী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
রোহিঙ্গা সংকট একটি ঐতিহাসিক সংকট। অতএব এই সংকট মোকাবিলায় ২০১৭ সালের আগে, বিভিন্ন সময়ে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কেবলমাত্র ২০১৭ সালে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিকে অধিক মনোযোগ স্থাপন করা হলে পূর্ববর্তী সময়ে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরার বিষয়গুলো উপেক্ষিত রয়ে যেতে পারে। ফলে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংকটকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় এনে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এর স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে।
এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আরও প্রত্যক্ষ ও জোরালো ভূমিকা পালনের জন্য বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টি করার কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা এখন পর্যন্ত খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই বহু পাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের কার্যকর কৌশল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ওআইসি, আসিয়ান এবং জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা পালন করার জন্য কূটনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক সংকটের বলি হিসেবে আর কত রোহিঙ্গা শরণার্থী রাষ্ট্রহীন মানবেতর জীবন যাপন করবে—এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের পরের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
বুলবুল সিদ্দিকী: সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।