সত্তর দশকের গোড়ার দিকে আমি যখন ছাত্র হিসেবে প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি, দেশটিকে দেখে ঠাহর করতে পারিনি তার ভেতরটা ফাঁপা। সে সময়টাকে বলা হতো ‘স্থবির সময়’, ইংরেজিতে ‘পিরিয়ড অব স্টাগনেশন’। শেষ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ শব্দটির উদ্ভাবক। দেশটাকে পিছাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু এগোচ্ছে না, এক জায়গায় ঠায় বসে। অর্থনৈতিক সংকট দানা বাঁধছে, যদিও আপাতভাবে সবই বেশ চলছে। আসলে যে সব ঠিক চলছে না, আমরা ছাত্র হিসেবেও বেশ বুঝতে পেরেছি। মনে আছে, খারকভ (এখনকার নাম খারকিভ) শহরে আসার সপ্তাহখানেক পরে ডিম কিনতে রাস্তায় লম্বা লাইন দিতে হয়েছিল। টয়লেট পেপার কিনতেও লম্বা লাইন দিতে হয়েছে। কোথাও গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে জানলে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে তড়িঘড়ি করে সে খবর পৌঁছে দিয়েছি। এসবের কোনো কিছুই অবশ্য আমাদের বিচলিত করেনি। মোটের ওপর তো সব চলে যাচ্ছিল।
কিন্তু দেশটা যে আসলে ভীষণ পিছিয়ে তা বোঝা গেল যখন বছর দু-এক পরে গ্রীষ্মের ছুটিতে লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ ঘটলে। মনে আছে, প্রথমে যে জিনিসটা আমি ডজনখানেক কিনেছিলাম, তা হলো টুথপেস্ট। মহাপরাক্রমশালী পরাশক্তি অথচ সে ব্যবহারযোগ্য টুথপেস্ট বানাতে পারে না। দোকানে যে টুথপেস্ট মেলে তা এত তেতো যে মুখে দেওয়া যায় না। জিনস বা অন্যান্য ফ্যাশন দুরস্ত জিনিসের তো প্রশ্নই ওঠে না। তাতে অবশ্য আমাদের মতো বিদেশি ছাত্রদের লাভই হয়েছিল। সাত পাউন্ডের জিনসের প্যান্ট লন্ডনের বাঙালিপাড়া থেকে কিনে এক শ-সোয়া শ রুবলে বিক্রি করা যেত।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশটি দ্রুত বদলে যায়। এ জন্য ভ্লাদিমির পুতিনকে অবশ্যই বাহবা দিতে হয়। একটানা ২০ বছর ক্ষমতায় বসে দেশটিকে তিনি শুধু একটি প্রথম শ্রেণির পুঁজিবাদী দেশ বানিয়েছেন তা–ই নয়, পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গেও তার সার্বিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। মস্কো এখন ইউরোপের যেকোনো দেশের রাজধানীর চেয়ে কম ঝাঁ চকচকে নয়। চোখধাঁধানো সুপারমার্কেট, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যাকডোনাল্ডস, গুচি হ্যান্ডব্যাগ বা বিএমডব্লিউ গাড়ি, সবই এখন হাতের নাগালে। সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পর তার উত্তরাধিকারী দেশ হিসেবে রুশ ফেডারেশনে জাতীয় সম্পদের যে লুট শুরু হয়, তার ফলে কয়েক ডজন অতিধনীর সৃষ্টি হয়। পুতিন নিজে তাঁদের একজন। একটি ভদ্র গোছের মধ্যবিত্ত শ্রেণিও গড়ে ওঠে। এই সব শহুরে মানুষ পুতিনের নতুন রাশিয়াকে আগ্রহের সঙ্গেই স্বাগত জানিয়েছে। হতে পারে পুতিন কর্তৃত্ববাদী, ভিন্নমতের গলা টিপে ধরতে বিষ প্রয়োগেও আপত্তি নেই। কিন্তু রাস্তার অপর পারে ম্যাকডোনাল্ডসের হামবার্গার তো মিলছে।
এই পরিস্থিতির একমাত্র বিকল্প, ক্ষমতা থেকে পুতিনের অপসারণ। এই যুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, একমাত্র তাঁর অপসারণের মধ্য দিয়েই সে যুদ্ধের অবসান হতে পারে। ব্রিটিশ সূত্রানুসারে, এই যুদ্ধে রাশিয়া কমপক্ষে ১৫ হাজার সৈন্য হারিয়েছে। ১০ জনের মতো জেনারেল নিহত হয়েছেন। তথ্যব্যবস্থার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় রাশিয়ার সাধারণ মানুষ এখনো যুদ্ধের সত্য চিত্রটির সঙ্গে পরিচিত নয়। কিন্তু এসব লাশ একসময় কফিনে করে ঘরে ফিরবে।
নিষেধাজ্ঞার কামড়
ইউক্রেনে আক্রমণ করার কারণে এসবের সবই হারাতে বসেছে রাশিয়ার মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশ রাশিয়ার ওপর যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগের সব দরজা-জানালা এক এক করে বন্ধ হয়ে আসছে। আই ফোন নেই, গুগল পে নেই, ব্যাংক থেকে বিদেশি অর্থ তোলার পথ বন্ধ। যুদ্ধের আগে সবাই ছুটত কায়রো, মিলান বা গোয়া। সব বন্ধ। হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ব্যাংককে আটকে পড়া রুশ পর্যটকেরা বিপদে পড়েছে, কারণ তাদের জন্য ভিসা বা মাস্টারকার্ড দিয়ে কেনাকাটা বন্ধ। রুশ বিমানে চেপে দেশে ফিরবে, তার সুযোগও সীমিত। রুশ বিমানের জন্য অনেক দেশের আকাশসীমা নিষিদ্ধ হয়েছে। বিদেশি যন্ত্রাংশের অভাবে অধিকাংশ রুশ বিমানের ওড়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
পুতিন নিজে বলছেন, বিদেশি নিষেধাজ্ঞাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকের হস্তক্ষেপে রুবলের মূল্যমান স্থিতিশীল করা সম্ভব হয়েছে। দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর শেয়ারবাজারে কেনাবেচাও শুরু হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামে অভিহিত করে পুতিন দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন, যে অর্থনৈতিক ঝটিকা যুদ্ধ পশ্চিম শুরু করেছিল, তা রাশিয়া কেবল সামলে উঠেছে তা–ই নয়। উল্টো পশ্চিমা দেশগুলোই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিপদ পড়েছে।
কথাটা সত্য নয়। খোদ রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান এলভিরা নাবিউলিনা রুশ পার্লামেন্টকে জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রই সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। দেশটির যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল, তার পেছনে একটা বড় ভূমিকা ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও ভোগ্যপণ্য। এখন সেসব আসা বন্ধ হওয়ায় কলকারখানা বন্ধ হতে বসেছে। এই মুহূর্তে চালিয়ে নেওয়া গেলেও নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘদিন বজায় থাকলে কঠিন সংকটে পড়বে দেশ।
নাবিউলিনার কথায়, ছোট–বড় সব ধরনের উৎপাদন ক্ষেত্রেই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠবে। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, রাশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদেরাও সাবধান করে বলেছেন, অবস্থা না বদলালে এ বছরে মোট জাতীয় উৎপাদন ৮ শতাংশ হ্রাস পাবে ও মুদ্রাস্ফীতি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০২২ সালেই জিডিপি সংকোচন ঘটবে ১২ দশমিক ২ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো রাশিয়ার তেল-গ্যাস কিনছে, এক হিসাবে তার মূল্যমান দৈনিক প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। যদি সত্যি সত্যি তাদের ঘোষিত রুশ তেল-গ্যাস আমদানি বন্ধ হয়, তাহলে বিপদ আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে সাড়ে তিন শ বিদেশি কোম্পানি দেশ ছেড়ে চলে গেছে। এর ফলে লাখ লাখ মোটা বেতনভোগী চাকরিজীবী বেকার হয়ে পড়েছেন। মস্কোর মেয়র বলেছেন, এঁদের সাহায্য করতে সাড়ে তিন বিলিয়ন রুবলের জরুরি কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে।
ব্লুমবার্গ নিউজ এক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে, পুতিনের এই যুদ্ধ কেবল একটি প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে নয়, তাঁর নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধেও। ইউক্রেনে অব্যাহত যুদ্ধ বাবদ রাশিয়াকে দৈনিক প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স হিসাব করে বলেছে, পশ্চিমের চাপানো অর্থনৈতিক যুদ্ধের ফলে গত ২০ বছরে রাশিয়া মোট জাতীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছিল, তার অনেকটাই উবে যাবে।
অন্য কথায়, বিদায় গুচি, বিদায় বিএমডব্লিউ, বিদায় সামার ভ্যাকেশন!
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একটি প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক স্থবিরতা। এর সঙ্গে যুক্ত করুন আফগানিস্তানে সামরিক বিপর্যয়। আফগানিস্তানে বছর দশেক কাটিয়ে, পনেরো হাজার সৈন্য খুইয়ে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ সে দেশ থেকে নিজের সব সৈন্য ফেরত নিয়ে আসেন। শেষ সৈন্যটি আফগান মাটি ছেড়ে আসে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯। এর ঠিক পৌনে তিন বছরের মাথায়, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক দেশটি বিলীন হয়ে যায়। ভয় হচ্ছে, ঠিক সেই রকম একটি সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে পুতিনের রাশিয়া।
সংকটের শেষ কোথায়
ইউক্রেনে রুশ হামলাকে ঘিরে যে সংকট তা শেষ হওয়ার দুটি পথ রয়েছে; হয় রাশিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করবে, অথবা ইউক্রেন এই যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাস্ত করবে। একটি তৃতীয় পথ হতে পারত কূটনৈতিক সমাধান। যুদ্ধ এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে কূটনৈতিক সমাধানের কোনো লক্ষণ আপাতত নেই। পুতিন আশা করেছিলেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কিয়েভের পতন হবে এবং সেখানে একটি রুশপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের লাল ঝান্ডা উড়িয়ে রুশ সৈন্যরা ফিরে আসবে। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। কিয়েভে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের হাতে নাকানিচুবানি খেয়ে রুশ সৈন্যরা সরে এসে জড় হয়েছে পূর্বে ও দক্ষিণে। নিজদের সাফল্যে ইউক্রেনীয়রা নিজেরাই এতটা বিস্মিত হয়েছে যে তারা এখন মনে করছে রাশিয়াকে পরাস্ত করার মতো ক্ষমতা ও মনোবল তাদের রয়েছে। পশ্চিমের কাছ থেকে দেদার অত্যাধুনিক অস্ত্র পাওয়ায় সে মনোবল আরও বেড়েছে। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে রুশ আক্রমণে ভীত হয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রাশিয়ার অধিকাংশ দাবি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি বেঁকে বসেছেন। পুতিনকে তিনি গণহত্যায় অভিযুক্ত করেছেন। যে লোকের হাতে তাঁর দেশের মানুষের রক্তের চিহ্ন, কীভাবে তাঁর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তিনি সন্ধি করবেন? ফ্যাসিজমের সঙ্গে মিল রেখে ইউক্রেনীয়রা এই যুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের নাম দিয়েছে ‘রাশিজমে’র বিরুদ্ধে লড়াই। পৃথিবীর মানুষ হিটলারের ফ্যাসিজমের সঙ্গে মৈত্রী করেনি। পুতিনের রাশিজমের সঙ্গেও কোনো মৈত্রী তারা করবে না। তারা পুতিনের নতুন নাম দিয়েছে বুচা ও মারিউপলের ‘কসাই’।
অন্যদিকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও যুদ্ধের ময়দান থেকে হটে আসা পুতিনের পক্ষে সম্ভব নয়। রুশ বিশেষজ্ঞ ইভান ক্রাতসভ ঠিকই বলেছেন, এটি পুতিনের যুদ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তিনি কখনো মানেননি, সেই ‘ঐতিহাসিক বিপর্যয়’ প্রত্যাখ্যান করে তিনি ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনা করতে চান। এই যুদ্ধে যেকোনো মূল্যে তাঁকে জয়লাভ করতেই হবে, অন্যথায় নিজ দেশের ভেতরেই তিনি বিদ্রোহের সম্মুখীন হবেন। জানা গেছে, ৯ মে—যা রুশদের কাছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে বিজয় দিবস হিসেবে পরিচিত, সে তারিখের মধ্যেই তিনি যেভাবেই হোক যুদ্ধটা সেরে ফেলতে চান। ইউক্রেনের পূর্বে ও দক্ষিণে তাঁর সৈন্য বাহিনী যদি ভদ্রগোছের সীমানা দখলে সক্ষম হয়, তাহলে তাকেই বিজয় ঘোষণা করে ক্ষান্ত হতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নয়া নিরাপত্তা রণকৌশল
সমস্যা হলো, এই যুদ্ধটা এখন আর রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে সীমিত নেই। যুদ্ধটি দাঁড়িয়েছে পুতিন বনাম পশ্চিমা বিশ্ব। শুরু হয়েছে এক নতুন শীতল যুদ্ধ। কূটনৈতিক সমাধানের কোনো পথ খোলা না থাকলে এই যুদ্ধ আরও কত দিন চলবে হলফ করে কেউ বলতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে টের পেয়েছে পুতিন বিপদে আছেন, ফলে শুধু মচকানো নয়, তাঁকে না ভাঙা পর্যন্ত সে থামবে না। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন কিয়েভে ঝটিকা সফরে এসে বলেই গেছেন, এই যুদ্ধে ওয়াশিংটনের লক্ষ্য রাশিয়াকে এতটা দুর্বল করে ফেলা, যেন ভবিষ্যতে সে আর কখনো অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে হামলার সাহস না করে। গত মাসে যে জাতীয় নিরাপত্তা রণকৌশলের খসড়া হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতেও স্পষ্ট বলা হয়েছে, আমেরিকা চায় রাশিয়াকে সর্বতোভাবে একঘরে করে ফেলতে। শুধু সামরিকভাবে নয়, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবেও তাকে একঘরে করা হবে। এই রণকৌশলের অংশ হিসেবে ওয়াশিংটনের উদ্যোগে রাশিয়াকে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
রাশিয়ার জন্য বাড়তি সমস্যা, এই যুদ্ধ তাকে একাই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। চীন ও ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখলেও সামরিকভাবে তার দিকে কুটোটিও এগিয়ে দেবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শুধু এক ইউক্রেন নয়, তার সঙ্গে রয়েছে ন্যাটোর ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তিরিশটি দেশ। যুদ্ধ মানে শুধু নতুন অস্ত্র পরীক্ষার সুযোগ নয়, দেদার মুনাফার সুযোগ। আমেরিকার সামরিক বাজেট চতুর্গুণ হবে, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের জন্য সেটি মস্ত সুখবর। ফলে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা আরও অনেক দিন এই যুদ্ধ চালিয়ে নেবে বলেই মনে হয়। অসম্ভব নয়, যদি এই যুদ্ধের ফলে ইউক্রেন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পশ্চিমা সামরিক জোট মোটামুটি সে হিসাবে করেই রেখেছে। রাশিয়াকে রক্তশূন্য করা ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনকে বলিদান করতে কোনো দ্বিধা তার থাকার কথা নয়।
এই পরিস্থিতির একমাত্র বিকল্প, ক্ষমতা থেকে পুতিনের অপসারণ। এই যুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, একমাত্র তাঁর অপসারণের মধ্য দিয়েই সে যুদ্ধের অবসান হতে পারে। ব্রিটিশ সূত্রানুসারে, এই যুদ্ধে রাশিয়া কমপক্ষে ১৫ হাজার সৈন্য হারিয়েছে। ১০ জনের মতো জেনারেল নিহত হয়েছেন। তথ্যব্যবস্থার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় রাশিয়ার সাধারণ মানুষ এখনো যুদ্ধের সত্য চিত্রটির সঙ্গে পরিচিত নয়। কিন্তু এসব লাশ একসময় কফিনে করে ঘরে ফিরবে। হাত বা পা হারিয়ে ঘরে ফিরবে ইভান ও আলেক্সি। আজ অথবা কাল দেশের ভেতরে এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ চাঙা হবেই। সেনা অফিসার ও সুবিধাভোগী অলিগার্কদের মধ্যেও ক্ষোভ উগরে উঠবে। রুশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক আন্দ্রেই সালদাতভ দাবি করেছেন, ক্রেমলিনের ভেতরে একা হয়ে পড়েছেন পুতিন। সামরিক ব্যর্থতার দায়ভার তাদের ওপর চাপিয়ে একাধিক শীর্ষ জেনারেলদের তিনি জেলে পাঠিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা একসময়ের মিত্র অতিধনীরাও এখন পুতিনের হঠকারিতার সমালোচনা শুরু করেছেন।
কত দিন এই বিরুদ্ধ-ঢেউ ঠেকিয়ে রাখবেন পুতিন?
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক