মাত্র কয়েক মাস আগে প্রথম আলোয় মৌলভীবাজার জেলার জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক স্থান নিয়ে লিখেছিলাম। একটি লাউয়াছড়া, অন্যটি বাইক্কা বিল। বন বিভাগ ইতিমধ্যেই লাউয়াছড়া বনের চূড়ান্ত সর্বনাশ করে ফেলেছে। জীববৈচিত্র্যে ভরা লাউয়াছড়ার প্রাকৃতিক বনটি ইতিমধ্যেই একটি হতশ্রী পার্কে পরিণত হয়েছে। পিকনিক পার্টি, সংগীতের আসর থেকে শুরু করে খেলাধুলা পর্যন্ত হেন কাজ নেই, যা সেখানে হয় না। সেই সুযোগে সেখানে তৎপর রয়েছে কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও।
পর্যটকদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে বন্য প্রাণীরাও সব পালিয়েছে। হনুমানের দেখা পাওয়াও রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে! সেখানে বেড়াতে যাওয়া মানুষের সর্বশেষ আক্রমণ এখন ক্ষুদ্র লতা-গুল্মের ওপর। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃক্ষায়ণের নামে বিদেশি বৃক্ষের চাষ। কাজটি কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতোই। যদি লাউয়াছড়ায় অতিদ্রুত পর্যটক নিষিদ্ধ করা না হয়, তাহলে আর কখনোই পুরোনো চেহারায় এটিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। কিন্তু বন বিভাগের এমন কোনো ইচ্ছা আছে বলে মনে হয় না; এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা আছে বলেও মনে হয় না। স্থানীয় প্রশাসন এখন বাইক্কা বিলকেও পর্যটনকেন্দ্র বানানোর যাবতীয় আয়োজন প্রায় সুসম্পন্ন করেছে। শীত মৌসুমে মানুষের পদচারণে বিরক্ত হয় অতিথি পাখিরাও। এ বছর সেখানে আরও একটি আত্মঘাতী ঘটনা ঘটেছে। শুকনো মৌসুমে স্থানীয় মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের আখড়াটি লুটপাট করে নষ্ট করেছে। কর্তৃপক্ষ এসব নিয়ে কিছু ভাবছে কি?
বন বিভাগের এবারের লোলুপ দৃষ্টি দেশের একমাত্র জলার বন রাতারগুলের দিকে। গত ২৩ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘বদলে যেতে পারে বনের প্রকৃতি’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে অন্তত তা-ই মনে হয়। সংবাদে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাতারগুলে পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন ও পর্যটকদের সুবিধার্থে বন বিভাগ সেখানে পাঁচ কোটি ৬১ লাখ টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ, প্রায় সোয়া চার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে পূর্ত খাতে; বাকি টাকা বনায়ন ও অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হবে।
আসলে প্রথমেই ভেবে দেখতে হবে, রাতারগুলকে আমরা নিরেট বন, না পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দেখতে চাই। কারণ, বন ও পর্যটন এক অর্থে সাংঘর্ষিক। বনকে পর্যটনকেন্দ্র বানাতে গেলে বনের প্রকৃত সত্তা নষ্ট হতে বাধ্য। বন বিভাগ এই একই ভুল করেছে লাউয়াছড়াসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নান্দনিক স্থানে। বনকে বনের মতো থাকতে দিতে হলে একে কোনো অবস্থায়ই বিরক্ত করা চলবে না। তৈরি করা যাবে না কোনো স্থাপনা, অবকাঠামো বা রাস্তাঘাট। এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা যতই বৃদ্ধি পাবে, ততই বাড়বে পর্যটকের সংখ্যা। বনের ভেতর স্থাপনা যত বাড়বে, বনভূমি ততই তার সৌন্দর্য হারাতে থাকবে; সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে দূষণ ও বিনষ্টের পরিমাণ। বনের নিবিড়তা বজায় রাখতে হলে অতিরিক্ত পর্যটক মোটেও কাম্য নয়। তবে বনে পর্যটকেরা বেড়াতে যাবেন না, এমনও নয়। কিন্তু এখনো অনেক পর্যটকই বনের নির্জনতা উপভোগ করতে জানেন না; অধিকন্তু, বনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন। তবে বন বিভাগ চাইলে নির্ধারিত দর্শনীর বিনিময়ে শুধু পানিপ্রবাহের সময় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বনের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় পর্যটকদের বেড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারে। নৌকা বা বাহনগুলোয় অবশ্যই ইঞ্জিন থাকবে না। কারণ, ইঞ্জিনের পোড়া তেল ও বিকট শব্দ বনের জন্য মোটেও সুখকর নয়।
দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও আয়তনের বিপরীতে পর্যাপ্ত বনভূমি নেই। তাই যেকোনো মূল্যে এসব বনভূমি টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। এমনিতেই শুকনো মৌসুমে রাতারগুল বনের প্রচুর গাছ কেটে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা; এখন যদি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়, তাহলে বন আর বন থাকবে না, হয়ে উঠবে বাজার। বর্ষায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিক্ষেপ করা বর্জ্য শুকনো মৌসুমে সরানোর জন্য বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে হবে বন বিভাগকে। যদি তা না করা হয়, তাহলে একসময় রাতারগুল আর বন থাকবে না, পরিণত হবে ঘুণে ধরা বৃক্ষের ধ্বংসস্তূপে।
৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের এই বন সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগ বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগই ব্যয় করতে পারে বনের নিরাপত্তায়। এখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বনের পাহারা জোরদার করা। চারপাশে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করে সমগ্র বন এলাকা নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। তা ছাড়া বনের ভেতর অযাচিত বনায়নও কাম্য নয়। আর বন বিভাগের বনায়ন মানেই তো ইউক্যালিপটাস, অ্যাকাশিয়া বা মেহগনির জঞ্জাল। এ বনের প্রধান দুটি বৃক্ষের মধ্যে হিজল ও করচ প্রাকৃতিকভাবেই বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। তবে সে জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশও প্রয়োজন। বন বিভাগ ১৯৭৩ সালেই রাতারগুলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করেছে। মূলত এই ঘোষণার মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ থেকেছে এত দিন। এখন হঠাৎ করে সেখানে এত তোড়জোড় কেন, কেন এত হইচই? উদ্দেশ্যটা একটু খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। আসলে বন বিভাগ কি সেখানে পর্যটকদের সেবা দিতে চায়, নাকি নিজেদের সেবা নিশ্চিত করতে চায়। প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে সরবরাহ ও সেবা খাত, মেরামত, সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন এবং সম্পদ সংগ্রহ ও ক্রয় বাবদ কতগুলো অপ্রয়োজনীয় খাত দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য যদি শুধু বন সংরক্ষণ হয়, তাহলে সেখানে বনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া আর কি কোনো জরুরি কাজ থাকতে পারে? কারণ, বনটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে সেখানে আর থাকলই বা কী? এসব কারণেই বন বিভাগকে রাতারগুল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে; সরে আসতে হবে উচ্চাভিলাষী ও অনাহূত কর্মকাণ্ড থেকে।
প্রসঙ্গত, সর্বস্তরের লেখক, সাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিকদের কাছে বিনীত অনুরোধ, রাতারগুল নিয়ে আর কোনো চটকদারি লেখা নয়। কারণ, রাতারগুলকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জোর করে পর্যটনকেন্দ্র বানানো ঠিক হবে না। আমরা রাতারগুলকে বন হিসেবেই দেখতে চাই, পর্যটনকেন্দ্র নয়।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
[email protected]