মাদরাসাগুলোতে হয় কি না জানি না, কিন্তু রোজই স্কুলে-স্কুলে এবং সরকারি অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ব্যস, ওই পর্যন্তই। নয়তো, আমাদের সমাজে রবীন্দ্রনাথ এর বেশি কল্কে পান না, আগেও পাননি, এখনো পান না। নোবেল পুরস্কার পেলেও রবীন্দ্রনাথ যে মুসলমান নন, এই সত্য বাঙালি মুসলমানরা ভুলে যেতে পারেন না। তাই তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা, বিমাতার প্রতি ভালোবাসার মতো—যতটা দায়িত্ববোধের কারণে, ততটা আন্তরিক নয়। আমাদের বলতে আমি কেবল সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছি না, সরকারকেও বোঝাচ্ছি, তা সে সরকার যে দলেরই হোক না কেন।
পাকিস্তান হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাকিস্তান সরকারের সুপরিকল্পিত বিদ্বেষ ছিল সাধারণ লোকের তুলনায় অনেক প্রবল। সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ না করে, সরকার রবীন্দ্রনাথকে যবনিকার আড়ালে ঠেলে দিতে চেয়েছিল তাঁর বদলে ইকবাল আর নজরুলকে মঞ্চে তুলে দিয়ে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনের ব্যাপারে সরকার এবং সরকার-প্রভাবিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোভাব ছিল নিত্যন্ত প্রতিকূল। চার বছর পরে—১৯৬৫ সালে যখন যুদ্ধ হলো ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে, তখনো রবীন্দ্রনাথের গান সরকারি মাধ্যমে নিষিদ্ধ হয় অলিখিতভাবে। ১৯৬৭ সালে নিষিদ্ধ হয় লিখিতভাবে।
সরকারের এ রকম বিরোধিতা সত্ত্বেও, সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশে রবীন্দ্র-অনুরাগ ছড়িয়ে পড়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী নানা রকমের রাজনৈতিক কারণে যে বাঙালিয়ানার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে, তার ফলে এটা সম্ভব হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সেই অনুরাগই তুঙ্গে ওঠে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে এবং মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে।
মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন দেশের জন্য। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের দানব বাহিনী লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, লাখ লাখ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিল, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, ব্যাপকভাবে লুটপাট করেছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ওই একবারই এবং ওই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যই আমাদের সমাজ রবীন্দ্রনাথকে আপন বলে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের পরে সেই রবীন্দ্রপ্রীতি মুছে যেতে দীর্ঘ সময় লাগেনি, সরকারের নয়, সমাজেরও নয়। তারপর আবার নজরুলকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আড়াল করার চেষ্টা চলে।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল এক এবং অনন্য। তাঁর কবি-জীবনের সূচনায় তাঁর হাত দিয়ে সৃজনশীলতার যে দারুণ বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার তুলনীয় দৃষ্টান্ত একমাত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর, তিনি তাঁর অসাম্প্রদায়িকতা দিয়ে যেভাবে একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান—উভয় সমাজকে জয় করেছিলেন, তার কোনো তুলনাই নেই। তাই সেই অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে যখন রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলে, তখন লজ্জা নিবারণের পথ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ বনাম নজরুল—এই সমীকরণের প্রতি আমাদের মনোভাব কেমন, সেটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে হয়:
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো এবং তাঁকে দেওয়া হলো বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। তাঁকে একুশে পদক দেওয়া হলো। তারপর তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলো। তাঁর নামে সড়কের নামকরণ করা হলো। তাঁর পরিবারের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁকে ঢাকায় সমাধিস্থ করা হলো। এমনকি, তাঁর নামে ত্রিশালে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলো। বাংলা একাডেমি দু-দুবার দুই আকারে নজরুল রচনাবলী প্রকাশ করল। আমাদের সবার গর্ব তিনি। তাঁর নামে আরও অনেক কিছু করা হোক।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতি এত অবহেলা কেন? ঢাকায় কি তাঁর নামে একটা রাস্তা হতে পারত না? কোনো বিশ্ববিদ্যালয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রাবাস? বাংলা একাডেমি শহীদুল্লাহ ভবন বানাল, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তন নামকরণ হলো, শামসুর রাহমান সভাকক্ষ করল, একবারও কোনো কিছুর নামকরণে রবীন্দ্রনাথের নাম মনে করল না!
রবীন্দ্রনাথকে আজ আমরা স্মরণ করি অথবা না-ই করি, তাতে তিনি বিচলিত হবেন না। কিন্তু তাঁকে স্মরণ করে আমরা নিজেদেরই সমৃদ্ধ করতে পারি। তাঁর মানবতার আদর্শ দিয়ে নিজেরাই উদ্বুদ্ধ হতে পারি। তাঁকে স্মরণ করা মানে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি বলে পরিচিত করা। এসবই সম্ভব যদি তাঁকে আমাদেরই লোক বলে বিবেচনা করি।
গোলাম মুরশিদ: লেখক, গবেষক।