দারিদ্র্য, দুর্ভাগ্য, জরুরি কর্মী হওয়ার সুবাদে অরক্ষিত হয়ে পড়া, নীতিনির্ধারকদের দুর্বল ব্যবস্থাপনা—ইত্যাদি কারণে লাখ লাখ মানুষ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প সংক্রমণের শিকার হয়েছেন একেবারে নিজের কারণে। করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ভাষ্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে ট্রাম্প শুধু নিজেই আক্রান্ত হননি, তাঁর এ তাচ্ছিল্য আমেরিকায় দ্রুত কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার ধোঁয়ায় বাতাসও দিয়েছে।
মহামারির শুরু থেকেই সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য জনগণকে মাস্ক পরতে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে এবং পারস্পরিক শারীরিক সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। ট্রাম্প এসব পরামর্শকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর এবং ফার্স্ট লেডির করোনা পজিটিভ ফল আসার মাত্র দুদিন আগে প্রথম বিতর্কে প্রতিপক্ষ জো বাইডেনের মাস্ক পরা নিয়ে মশকরা করেছেন। বিতর্ক অনুষ্ঠানে জো বাইডেনকে লক্ষ করে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি তাঁর (বাইডেন) মতো মাস্ক পরে থাকি না। যখনই আপনারা তাঁর দিকে তাকাবেন, তখনই দেখবেন তাঁর মুখে একটা মাস্ক লাগানো। তিনি ২০০ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলেন...তাঁর মুখে যে মাস্ক লাগানো থাকে তার চেয়ে বড় মাস্ক আমি জীবনে দেখিনি।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ট্রাম্প গত কয়েক মাসে বিশাল হলরুমে এবং খোলা জায়গায় নির্বাচনী সমাবেশ করেছেন। সেখানে আগত কর্মী–সমর্থকদের মুখে মাস্ক ছিল না। হোয়াইট হাউস থেকে তাঁকে অন্য কর্মকর্তাদের থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হলেও তিনি তা কানে তোলেননি।
কোভিড-১৯ নিয়ে ট্রাম্প ধারাবাহিকভাবে ঠাট্টা–মশকরা করে যাওয়ার কারণে সারা আমেরিকায় তাঁর সমর্থকদের মধ্যে এ রোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার প্রবণতা কমে যায়। তাঁদের অনেকেই এ ভাইরাস নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। এতে ভাইরাসটি দ্রুততায় ছড়িয়েছে। অনেক আমেরিকানেরই এ ভাইরাসের ভয়াবহতার বিষয়ে মৌলিক ধারণা কম। ফলে ট্রাম্প এবং তাঁকে সমর্থন করা সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজের বক্তব্যে এই নাগরিকেরা দ্রুত প্রভাবিত হয়েছেন।
বিজ্ঞানমনস্ক পরামর্শকে ট্রাম্পের তাচ্ছিল্য করার শিকড় আমেরিকান রাজনীতি ও সংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত। তাঁর বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তার দুটি উদ্দেশ্য আছে। প্রথম উদ্দেশ্য হলো রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক কট্টরপন্থী শ্বেতাঙ্গ ও ইভেনজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের সংহত করা। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার চেয়ে অবৈজ্ঞানিক বাইবেলীয় ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী কট্টর খ্রিষ্টানরা যাতে ধারণা করেন, ট্রাম্প ধর্মীয় শাস্ত্রের অনুসারী, সে কারণে তিনি সব বৈজ্ঞানিক যুক্তি–পরামর্শ এড়িয়ে গেছেন।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো আজকের আধুনিক রিপাবলিকান পার্টি যে পরিবেশবাদীদের ভাষ্যের সঙ্গে একমত নয় তা বুঝিয়ে দেওয়া। ‘বিগ ওয়েল’ এবং ‘বিগ কোল’ নামের দুটি জ্বালানি কোম্পানির কাছ থেকে বছরের পর বছর মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া দলটি যে পরিবেশবাদীদের কথায় বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থবিরোধী কাজ করবে না, তা ট্রাম্প কথা ও কাজ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
এ কারণেই তিনি পরিবেশবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করছেন। তিনি যেভাবে ‘করোনাভাইরাস এমনিতেই নাই হয়ে যাবে’ বলেছেন, ঠিক একইভাবে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা জাদুর মতো উবে যাবে। ধরিত্রী ঠান্ডা হতে শুরু করবে। একটু ধৈর্য ধরুন।’ এসব কথা মোটেও কাকতালীয় নয়। এর মধ্যে পরিবেশবাদীদের কোণঠাসা করা এবং বৃহৎ পুঁজির শিল্প স্বার্থ রক্ষা করার দ্যোতনা নিহিত আছে।
ট্রাম্পের বিজ্ঞানবিরোধী পদক্ষেপ গোটা বিশ্বকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। তাঁর প্রশাসন ইতিমধ্যে জলবায়ু–সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এতে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা এবং কোভিড-১৯ মোকাবিলা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে গ্রহণ করে তা মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষণ দেওয়া ট্রাম্পের উচিত ছিল। কিন্তু তিনি এবং তাঁর আরেক ইভেনজেলিক্যাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তা না করে চীনের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান ক্রুসেড শুরু করার চেষ্টা করলেন।
ট্রাম্পের কোভিডে আক্রান্ত হওয়া আমেরিকানদের মধ্যে জনস্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতা বাড়াবে কি না, তা বলা দুরূহ। কারণ ফক্স নিউজ, ইভেনজেলিক্যাল মতাদর্শ এবং করপোরেট প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলো যেভাবে এ দুই ইস্যুতে অবৈজ্ঞানিক ভাষ্য ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে রিপাবলিকান সমর্থকদের চেতনা ফিরবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
আমি চাই ট্রাম্প সুস্থ হয়ে উঠুন, কিন্তু তাঁর সুস্থতা আমেরিকাকে অপশাসন থেকে ফেরাতে পারবে, সেটি আশা করতে পারছি না। আমি চাই জো বাইডেন জিতে যাক। পরাজিত ট্রাম্পের ব্যাংক ও বিমা জালিয়াতির স্বচ্ছ তদন্ত হোক। মিথ্যার মধ্য থেকে আসল সত্য বেরিয়ে আসুক।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
* জেফরি ডি. স্যাক্স কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এবং হেলথ পলিসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ের অধ্যাপক