সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান বিনা বাধায় কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিতে যত অগ্রসর হচ্ছে, আফগান সরকারের সঙ্গে তাদের শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন তত সামনে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা মূলত এ প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসছে। এশিয়ার পরাশক্তি চীনের কণ্ঠেও দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনার বারতা। পশ্চিমা মিডিয়া ও তাদের বুদ্ধিজীবীদের আফগান ও তালেবান প্রশ্নে ভাষা, শব্দচয়ন ও বিশ্লেষণও নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। এত দিন তাদের কাছে অতিচেনা সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এখন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
তালেবানের কূটনৈতিক সাফল্য পশ্চিমা বিশ্লেষকদের প্রশংসায় ভাসছে। কী এমন জাদুবলে ২০ বছরের সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী থেকে তালেবানরা ঝানু রাজনৈতিক শক্তি হয়ে গেল? আফগানিস্তানের ভাগ্যে আসলে কী ঘটতে চলেছে?
টুইন টাওয়ার হামলার ২০তম বর্ষপূর্তির দিনটাতে (১১ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের শেষ সৈন্যটিকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে পরিস্থিতি যা তাতে বলা যায়, এর অনেক আগেই সেখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে হতে পারে তাদের। টুইন টাওয়ারে হামলাকে কেন্দ্র করেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। এ যুদ্ধের স্পষ্ট ঘোষণা ছিল, ‘হয় তুমি আমার পক্ষে, না হয় তুমি সন্ত্রাসবাদী’। ৭ অক্টোবর, ২০০১ আফগানিস্তানে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধ। পরবর্তী দুই দশক সারা বিশ্বকে ‘ওয়ার অন টেরর’-এর ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
একদিকে আল–কায়েদা, আইএস, আলশাবাবের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের দেশে দেশে মানুষকে মুক্ত করার নামে আগ্রাসন, দখলদারি, বোমা হামলা। ফলে শিশু-নারীসহ লাখ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটেছে। ধ্বংস হয়েছে অর্থনীতি ও মানুষের আবাসভূমি, প্রাচীন সভ্যতার অমূল্য নিদর্শন। শরণার্থীর স্রোত সাগরের লোনাপানিতে ভাসতে ভাসতে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়েছে।
‘শীতল যুদ্ধ’ শেষ হওয়ার পরে একক ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখা এবং যুদ্ধ অর্থনীতির মাধ্যমে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে জনগণের করের অর্থ তুলে দেওয়া ছিল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্তর্গত কারণ। এই যুদ্ধে একদিকে জনপদের পর জনপদ বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে পুনর্গঠনের নামে ঠিকাদারদের হাতে সেসব ভূখণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি সফল হয়নি। উল্টো অর্থনৈতিক সংকটকে ডেকে এনেছে।
২০০৭-০৮-এ যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছিল, সেই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। একের পর এক যুদ্ধ ফ্রন্ট তাদের খুলতে হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম যুদ্ধ অর্থনীতির কিছুটা রাশ টেনে ধরেন। ইরাক থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয় তাঁর প্রশাসন। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয় তাঁর আমলেই। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্প জমানার সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন।
আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পেছনে অন্য যেকোনো কারণের চেয়ে মার্কিন অর্থনীতির রুগ্ণ দশাকে সামনে রাখতে হবে। সরাসরি যুদ্ধ পরিচালনার যে বিপুল ব্যয়, পুনর্গঠন অর্থনীতি থেকে তা উঠে আসেনি। গত ২০ বছরে শুধু আফগান যুদ্ধেই মার্কিনদের ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ২৬১ ট্রিলিয়ন ডলার। বিপুল এ ব্যয়ের বোঝা চেপেছে আমেরিকার সাধারণ মানুষের ওপর। উপরন্তু, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের আত্মবিনাশী নীতিতে জড়িয়ে পড়ে ট্রাম্প প্রশাসন। এর ফলে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি খাত ব্যাপক ধরাশায়ী হয়েছে।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে করোনা মহামারি। দেশটিতে বেকারত্ব ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি পড়ে গেছে। এ সময়ে শীর্ষ ধনীদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলেও সাধারণ মানুষের আয় ও জীবনযাত্রা পড়ে গেছে। ফলে তাদের ওপর আরও করের বোঝা চাপিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। যুদ্ধ বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে করনীতি পরিবর্তনের দাবি সেখানে জোরদার হয়েছে। প্রবীণ ডেমোক্র্যাট নেতা বার্নি স্যান্ডার্স দীর্ঘদিন ধরে অতি ধনী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের আয়ের ন্যায্য অংশ রাজস্ব হিসাবে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। দেশটির সিনেটে এ ধরনের একটা বিলও উঠেছে।
তালেবানের কাছে তাড়া খেয়ে কাবুল থেকে মার্কিনরা পালাচ্ছে, এ রকম যুক্তি একপেশে। কয়েক বছরের পরিকল্পনা, আলোচনা ও কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়েই তালেবানের ক্ষমতা দখল ও মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার হচ্ছে। আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কাতারের দোহায় আলোচনার টেবিলে তালেবানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ২০১৮ সালে। তালেবান প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটনে আলোচনায় বসেছেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত কয়েক মাসে রাশিয়া, চীন, ইরান, তুরস্ক ও ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন তাঁরা। ধীরে ধীরে জঙ্গিগোষ্ঠী থেকে তাদের রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে সায়গনে মার্কিনদের পরাজয়ের সঙ্গে কাবুলের সৈন্য প্রত্যাহারের যে তুলনা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে, সেটা যথার্থ নয়। পরাজিত হয়েই সায়গন ছাড়তে হয়েছিল তাদের। কিন্তু পুরোনো মিত্র তালেবানের সঙ্গে মার্কিনরা ‘উইন-উইন’ কূটনীতির পথেই এগিয়েছে। সত্যিকারের কোনো বাধা ছাড়াই একের পর এক প্রদেশ দখল, রাজধানী কাবুলে তালেবানের প্রবেশ প্রকৃতপক্ষে কী ইঙ্গিত দেয়? যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সহযোগিতায় গঠিত আফগান সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ও সমরসজ্জা তালেবানের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ও আধুনিক। তারপরও তারা তালেবানের সঙ্গে পেরে উঠল না কেন?
আফগান জনগণের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে তাদের মদদপুষ্ট সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। শীতলযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বীকে শায়েস্তা করতে সেখানে উত্থান হয় তালেবানের। কমিউনিস্টদের ঠেকাতে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সহায়তায় তালেবানকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম জোগায় আমেরিকা। সেই তালেবানই হয়ে ওঠে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার প্রথম দুশমন।
তালেবানের হাতে কাবুলের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশটিতে জনগণের যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও রক্তক্ষয়, নারীদের দুর্দশা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে করুণ চিত্র, তার অবসান শিগগিরই হচ্ছে না।ভূরাজনৈতিকভাবে আফগানিস্তানের গুরুত্ব, সেখানকার গোত্রীয় জীবন ও জনমিতি, ভবিষ্যতে এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ—সবকিছু মিলিয়ে আফগান জনগণের ভাগ্যবিধাতা প্রসন্ন নন। ২০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন সেখানে আগ্রাসন শুরু করে, তখন সেটা আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০ বছর পরে তারা যখন চলে যাচ্ছে, তখন সেখানে চীন, পাকিস্তান, ভারত, রাশিয়া, ইরান, কাতার ও তুরস্কের স্বার্থও যুক্ত হয়েছে।
মনোজ দে অনুবাদক ও সংবাদকর্মী