অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, যিনি ন্যাপ বা কুঁড়েঘরের মোজাফফর হিসেবে অধিক পরিচিত, আজ তাঁর শততম জন্মদিন। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট ৯৮ বছর বয়সে মারা যান।
গেল শতকের ত্রিশের দশকে মোজাফফর আহমদের ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ কমিউনিস্ট পার্টি–সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনের হাত ধরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন, অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর কিছুদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। চুয়ান্নতে ৩২ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে মোজাফফর আহমদ পুরোপুরি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং মুসলিম লীগের এক মন্ত্রীকে পরাজিত করে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় তিনি স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, সেটি আমাদের নেতা মাওলানা ভাসানীর একক কিংবা কোনো একটি দলের দাবি নয়। এটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষের দাবি। আবেগের কিংবা ভোট লাভের স্লোগান নয়। এটি হলো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা।’
১৯৫৭ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করার পর আরও অনেকের সঙ্গে মোজাফফর আহমদের ওপরও হুলিয়া জারি হয়। ৮ বছর আত্মগোপনে থেকে কাজ করার পর তিনি ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্ত হলে মোজাফফর পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি হন। আমৃত্যু সেই পদেই ছিলেন।
মোজাফফর আহমদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সফলতা-ব্যর্থতা—দুটোই আছে। সফলতা হলো, তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বামপন্থায় আস্থাশীল ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে গঠিত সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে পৃথক গেরিলা বাহিনী গঠনেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় নতুন বাংলা নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে ন্যাপের মুখপত্র হয়। এ সময় জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন মোজাফফর আহমদ। স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানের আমলে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
ব্যর্থতা হলো, মোজাফফর আহমদ যখন পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি হন, তখন দল অনেক বড় ছিল, বিরাট কর্মী বাহিনী ছিল; কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই সেই দল টুকরা টুকরা হয়ে যায়। তিনি যাঁদের নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই জীবদ্দশায় তাঁকে ছেড়ে চলে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কুঁড়েঘরের নিঃসঙ্গ বাসিন্দা।
পঁচাত্তরের পর মোজাফফর আহমদের একটি রাজনৈতিক স্লোগান বেশ সমালোচিত হয়েছিল, ‘ধর্মকর্ম সমাজতন্ত্র’। মোজাফফর আহমদ যে কথাটি চার দশক আগে সরাসরি বলেছেন, পরবর্তীকালে অনেক বাম ও সেক্যুলার দল তা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সামনে এনে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে এবং এখনো করছে।
এই ব্যর্থতার পাশাপাশি স্বীকার করতে হবে, মোজাফফর আহমদই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ কাউকে ক্ষমতার হিস্যা দিতে রাজি হয়নি। অথচ দলটি যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে পেরে
উঠছিল না, তখন ন্যাপ ও সিপিবিকে নিয়ে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ন্যাপ-সিপিবির নেতারা ঐক্যজোটের বৈঠকে বাকশালের বিরোধিতা করলেও এর পুরো দায় তাঁদের নিতে হয়। আওয়ামী লীগের ডানপন্থী অংশ প্রচার চালায়, ন্যাপ-সিপিবির পরামর্শেই বঙ্গবন্ধু বাকশাল করেছিলেন। ন্যাপের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য সম্প্রতি এই লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এই প্রচারণা পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক। সিপিবির সভাপতি মণি সিংহ ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের বৈঠকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ব্রিটিশ ধারার গণতন্ত্রে অভ্যস্ত এ দেশের মানুষ একদলীয় ব্যবস্থা মেনে নেবেন কি না।
একাত্তরে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে মোজাফফর আহমদ নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। সে সময়ে উত্তর আমেরিকাপ্রবাসী পাকিস্তানিদের সাময়িকী পাকিস্তান ফোরামকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সংগ্রাম যেখানে শেষ হবে, সেখান থেকেই বামপন্থীদের সংগ্রাম শুরু হবে। বাস্তবে তা হয়নি। নকশালদের আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর উত্তরটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বললেন, তারা জোতদারদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে চায়, কিন্তু পুরো দেশটি যারা দখল করে আছে, তাদের উচ্ছেদ
করতে চায় না।
প্রশ্নকর্তা যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করছিলেন, মোজাফফর আহমদ বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘সেটি আপনার ধারণা হতে পারে। আসলে আমার কীই-বা অবদান? দেশের জনগণের আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামে নিজের অবদানকে অতি শ্রেয় ভাবা ঠিক নয়।
মোজাফফর আহমদ দেশ ও জনগণের জন্য কী করেছেন, তার বিচার সময় করবে। তবে এ কথা মানতে হবে যে তিনি পঞ্চাশের দশক থেকে আমাদের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়ার পর তিনি রাজনীতির বাইরে কিছু করেননি।
শততম জন্মদিনে মোজাফফর আহমদের একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ না করলে তাঁর প্রতি অবিচার হবে। যে দেশে রাষ্ট্রীয় পদ ও পদক পাওয়ার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সে দেশের একজন রাজনীতিক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ফিরিয়ে দিয়েছেন, এটি কম কথা নয়। ২০১৫ সালে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। পদ বা পদবির জন্য কখনো রাজনীতি করিনি। পদক দিলে বা নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই।’
শততম জন্মদিনে মোজাফফর আহমদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি