মূল্যস্ফীতি নিয়ে গত অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকার বেশ আশাবাদ শুনিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তার মুদ্রানীতিতে বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মুদ্রানীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনেক সময় প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ—এই দুটির যেকোনো একটিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হয়। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে, যা ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার সরকারি আশাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আগের বছরের তুলনায় কমেনি, বরং বেড়েছে।
প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো, একজন মানুষ আর আগের বছর যে মানের জীবনযাপন করত, সেই একই মানের জীবনযাপন করতে গত অর্থবছর তাকে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরে যাপিত জীবনমান ধরে রাখার জন্য ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
তবে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিষয়ে কিছুটা কৃতিত্বের বৈধ দাবিদার। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মূল্যস্ফীতিকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখা, যা তারা করতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতিকে শুধু সংখ্যার হিসাব দিয়ে বিচার করা ঠিক হয় না, তার ধরনটির ওপরও আলোকপাত করতে হয়। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির মূল নিয়ামক ছিল খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ হলেও খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে সেটা ছিল প্রায় ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা তার আগের বছরে ছিল ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করার সময় অনুমান করে নেওয়া হয় যে খাদ্যের ওপর ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ আমাদের মোট ব্যয়ের ৫৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদি কোনো পরিবারের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ তার মোট ব্যয়ের অংশ হিসাবে তার চেয়ে অধিক হয়, তাহলে সেই পরিবারকে গত বছরে যাপিত জীবনমান অটুট রাখার জন্য গত বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশের চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।
যারা সাধারণত তাদের মোট ব্যয়ের বড় অংশ খাদ্যসামগ্রীতে ব্যয় করে, তারা মূলত স্বল্প আয়ের মানুষ। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় আয়-প্রবৃদ্ধির সুবিধাবঞ্চিত থেকে যায়। তাই সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের কম হলেও উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের জীবনে ব্যয়ের বোঝা আনুপাতিক হারে অনেক বেশি বেড়ে যাবে। অর্থাৎ গত বছরের মূল্যস্ফীতির যা ধরন, তাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর তার প্রভাবটা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি পড়েছে। অংশীদারিমূলক উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা উদ্বেগের বিষয়।
আবার দেখা যাচ্ছে, শহুরে এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, প্রায় ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর অর্থ হলো, শহরসমূহে যেসব কর্মজীবী স্বল্প আয়ের মানুষ বাস করছে, যারা তাদের আয়ের একটা বড় অংশ খরচ করে খাদ্যসামগ্রীতে, তাদের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা গত অর্থবছরে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের শিল্প খাতের যতটুকু প্রসার হয়েছে, তার পেছনে অন্যতম প্রধান অনুঘটক ছিল নিম্ন মজুরি। আর এই নিম্ন মজুরিভিত্তিক শিল্পায়ন হুমকির মুখে পড়বে যদি শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত বছরের মতো বাড়তেই থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানো না গেলে শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান ব্যাহত হবে।
মূল্যস্ফীতিকে সরকার তার লক্ষ্য মোতাবেক সাড়ে ৭ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখতে পারলেও মূল্যস্ফীতির যে প্রকৃতি গত অর্থবছরে পরিলক্ষিত হয়েছে, তা অর্থনীতির জন্য সামগ্রিকভাবে অশুভ পরিণতির ইঙ্গিত বহন করে। আশি বা নব্বইয়ের দশকে নিম্ন মজুরি প্রদান করেই যে হারে গ্রামীণ এলাকা থেকে, বিশেষ করে কৃষি খাত থেকে শ্রমিক এনে শহুরে এলাকায় শিল্প খাতে নিয়োগ করা যেত, সেটা এখন সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এমনটিই ঘটে দুনিয়াব্যাপী। তার ওপর খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যোগ হয় তাহলে শিল্পায়ন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে। গত অর্থবছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে যেভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে শহর এলাকায়, তা বাংলাদেশের শিল্পায়নের স্বার্থে একটি গুরুতর সতর্কবার্তাই দিচ্ছে। সামগ্রিক উন্নয়নের খাতিরে এই সতর্কবার্তাকে সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিত।
খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি অনেক কমে এসেছে। গত অর্থবছরে তা ছিল ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। আপাতদৃষ্টিতে এটি শুভকর। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিষয়টি আসলে ভালোর চেয়ে খারাপের ইঙ্গিতই বেশি বহন করছে। অর্থাৎ খাদ্যবহির্ভূত চাহিদা আগের বছরের তুলনায় কম হারে বাড়া। গত অর্থবছরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমার পেছনে মূল কারণটা হলো চাহিদার নিম্নমুখী প্রবণতা, যার সঙ্গে সম্পৃক্ত মূল কারণ হলো মানুষের ব্যয়ক্ষমতার অপ্রতুলতা।
আমাদের প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরে ৬ শতাংশ হয়েছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবতা হলো মানুষের ব্যয়ক্ষমতা অন্যান্য বছরের তুলনায় একই হারে বাড়েনি। মানুষ একই হারে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ক্রয় করেনি। আর সে জন্যই খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে চাহিদার এ রকম হ্রাস মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের চাকাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মোটেও ভালো নয়। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে—এ রকম আত্মতুষ্টিতে না থেকে বরং সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা না বাড়ার কারণগুলো কী কী। এগুলো দূরীকরণ ছাড়া অর্থনীতির চাকা সামনে এগোবে না।
প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির উপাত্ত অনুযায়ী শহর এবং গ্রামাঞ্চলে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এক রকম নয়। গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেশি এবং শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি। এর পেছনে মূল কারণ হলো সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতা, বিপণনব্যবস্থার অদক্ষতা। গ্রামে উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য আসতে আসতে দাম বেড়ে যায়, আর শহরে উৎপাদিত শিল্পজ পণ্য গ্রামাঞ্চলে যেতে যেতে দাম বেড়ে যায়। বিদ্যমান উপাত্ত অনুযায়ী এই দাম বাড়ার পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি। এসব দুর্বলতা এবং অদক্ষতা দূর না করে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে না।
আবুল বাসার: গবেষক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), সাবেক অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক।
[email protected]