মাদকের নেশা থেকে দূরে থাকুন

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৮৭ সালের ৪২তম অধিবেশনে পৃথিবীকে মাদকের করালগ্রাস থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রতিবছরের ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এবারের স্লোগান—মাদকের নেশা নয়, স্বাস্থ্যই হোক জীবনের নতুন প্রত্যাশা। বাংলাদেশের যুবসমাজের একটি বিরাট অংশ আজ মাদকের করালগ্রাসে নিমজ্জিত। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই দেশে যুবসমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
প্রশ্ন জাগে, যে ছেলেটি আজ বাবা-মায়ের মাথার ঘাম পায়ে ফেলানোর কষ্টার্জিত অর্থ নিয়ে নামকরা একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে, সে কেন আজ মাদকাসক্ত?
পুলিশ প্রশাসনের মতে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও খুনসহ রাজধানীতে সংঘটিত অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গেই মাদকাসক্তির সম্পর্ক রয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে ৯৮ শতাংশই মাদকাসক্ত এবং তার মধ্যে ৪৪ শতাংশই বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর ৫৭ হাজার লোকের মৃত্যু হয় এবং তিন লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে।

 সিগারেট থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি আসক্তি তাদের ধীরে ধীরে শুরু হয়। বেশির ভাগই শুরু হয় বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে। মূলত মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর-তরুণেরা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।  বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদকাসক্তির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। যেসব দেশে মাদক উৎপাদিত হয় সেসব দেশের চক্রের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থিত, যেমন দক্ষিণ-পূর্বে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও লাওসে পপিগাছ (আফিম) উৎপন্ন হয়। আবার উত্তর-পশ্চিমে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান। ফলে এতদঞ্চলের মাদক ব্যবসার প্রভাব বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে।

ইয়াবা একটি মারাত্মক ক্ষতিকর মাদক। এটি নিয়মিত গ্রহণ করলে মস্তিষ্ক কোষে ডোপামাইন কমে গিয়ে পারকিনসনস রোগ হতে পারে। ইয়াবা মস্তিষ্কের রক্তবাহী সূক্ষ্ম নালিগুলোকে ধ্বংস করে ব্রেইনস্ট্রোক ঘটাতে পারে।

সম্প্রতি একটি সংবাদ আমাদের সবার দৃষ্টি কেড়েছে তা হলো কলেজছাত্রী ও বিদেশি নাগরিকসহ ১০ জন আটক। রাজধানী থেকে ৩০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে ঢাকা ডিবি পুলিশ। এ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক কলেজছাত্রীসহ ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। সীমান্তপথে প্রতিদিন গড়ে অন্তত দুই লাখ বোতল ফেনসিডিল দেশে ঢুকছে। অর্থাৎ বার্ষিক জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশের সমান টাকা ধ্বংস হচ্ছে এ নেশার পেছনে।

বিশ্ব মাদক পরিস্থিতি ২০১২ সালে, বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে প্রবণতা বেড়েছে। ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপতির সচিবালয় থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে যখন পৃথক করা হয়, তখন পরিকল্পনা ছিল যে অধিদপ্তরের জন্য হেলিকপ্টার, গাড়ি, আলাদা পোশাক ও অস্ত্র দেওয়া হবে। ২০ বছর পার হলেও কিছুই পাওয়া যায়নি। মাদক বিক্রেতাদের ধরতে অস্ত্র ছাড়াই খালি হাত-পা নিয়ে যেতে হয়।

১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে মাদক অপরাধের মতো গুরুতর অপরাধ মোকাবিলায় জনবল মাত্র ৭০০ জনের মতো। তাতে হিসাবমতে, প্রতি দুই লাখ ২৮ হাজার ৫০০ জনের জন্য একজন মাত্র মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মচারী। মাঠপর্যায়ে ৫০৬ জন নিরস্ত্র মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মচারী, মাদক অপরাধ দমন কাজে নিয়োজিত অর্থাৎ প্রতি দুই লাখ ৮৩ হাজার জন মানুষের বিপরীতে একজন নিরস্ত্র মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মচারী কর্মকর্তা নিয়োজিত। অতএব, এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য মাদক নিয়ন্ত্রণ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রয়োজন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে সব ক্ষেত্রেই আরও বেশি শক্তিশালী, গতিশীল ও কার্যকর করার জন্য লোকবল, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ দক্ষ প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ নিয়োগ প্রয়োজন।

ইউনাইটেড স্টেটস ওয়ার্ল্ডের রিপোর্টে বলা হয়, পিতা-মাতাই পারেন সন্তানকে মাদকের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে। সুতরাং পিতা-মাতারা, আপনার সময়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ সন্তানের দেখাশোনার জন্য বরাদ্দ রাখুন, তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করুন।

তাদের অসুবিধাগুলো সমাধানে সচেতন হোন, আপনার অসুবিধাগুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করুন।

সমাজে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা না থাকলে, নানা ক্ষেত্রে অবক্ষয়, হতাশা বাড়তে থাকলে মাদকাসক্তি বাড়বে। তাই অসুস্থ সংস্কৃতির বলয় থেকে আমাদের বের হতে হবে, মানবিক মূল্যবোধকে আবার জাগরিত করতে হবে। তবেই আসবে মুক্তি।

সুতরাং, আমাদের আবার পূর্বপরিচয়ে ফিরে যেতে হবে, যেখানে একটি পরিবারে বাবা-মা, সন্তান, চাচা-চাচি, মামা-মামি, ফুফা-ফুফু, নানা-নানি—সবাইকে নিয়ে আমরা বসবাস করতাম, সবাই সবার আনন্দ, সুখ, ব্যথা, বেদনাকে ভাগাভাগি করে নিতাম। তাতে পরস্পরের যে সমস্যা দুঃখ-যন্ত্রণা আছে, তা সহজেই সমাধান করতে পারতাম।

কিন্তু বর্তমানে আমরা সবাই এককেন্দ্রিক হয়ে গেছি, আমরা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করি না, ফলে দেখা দিচ্ছে অবক্ষয়, অসামাজিক কাণ্ডকীর্তি। তাই এখন প্রয়োজন সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করা। প্রয়োজন, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক আরও নিবিড় করা।

তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে যে মাদক নিয়ন্ত্রণের চারটি ধাপ আছে:

১. চাহিদা হ্রাস। এ জন্য গণসচেতনতা প্রয়োজন।

২. সরবরাহ হ্রাস। এ ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি।

৩. ক্ষতি হ্রাস। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে এটি করা যায়।

৪. রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

এ জন্য সরকারের প্রচেষ্টাও যেমন আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন, তেমনি নিবিড় পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম শক্তিশালী করা জরুরি।

অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস