যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল এখনো জানা যায়নি। অবশ্য রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা দিয়ে ভিত্তিহীনভাবে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
এদিকে অন্তত ছয়টি অঙ্গরাজ্যে এখনো (গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা) ভোটের ফল কোন দিকে যাচ্ছে, তা ধারণা করা যাচ্ছিল না। এই অবস্থায় সবার মনেই প্রশ্ন, এই পরিস্থিতির অবসান কবে হবে?
শেষ পর্যন্ত ফল কী হবে, সেটা না জানা গেলেও একটা বিষয় স্পষ্ট যে নির্বাচনের আগে জনমত জরিপগুলোর পূর্বাভাস শেষ পর্যন্ত বাস্তবে দেখা গেল না। ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় কিছু ভুলের পর এই বিষয়ে যে সংশয়ের সূচনা হয়েছিল, এখন তা আরও দৃঢ় হলো। এটি আগামী দিনে জনমত জরিপের ব্যাপারে যে আস্থাহীনতা তৈরি করল, তার প্রভাব কেবল গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের ওপর পড়বে তা নয়, এর ফলে আগামী দিনে ক্ষমতাসীন সরকার ও দল যেকোনো ধরনের জনমতকেই অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করবে। এই প্রবণতা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে থাকা দেশগুলোতে একটা বড় ধরনের বিপদ তৈরি করবে। এটি পদ্ধতিগত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।
কিন্তু এখন পর্যন্ত যে ফল জানা গেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজ বিষয়ে কিছু সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। চার বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সময়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বহুবিধ সমালোচনা এবং করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তাঁর সমূহ ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ এখন গভীরভাবে বিভক্ত। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের বিস্তারিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, রিপাবলিকান পার্টির যেখানে সমর্থন ছিল, সেখানে তাদের সমর্থন আরও বেড়েছে, বিপরীতে ডেমোক্র্যাটদের নিজের এলাকায় তাদের সমর্থনও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এটি সমাজের ভেতরে মেরুকরণের এক গভীর অসুখের কথাই তুলে ধরেছে।
এই পরিস্থিতির আরও প্রমাণ আমরা দেখতে পেয়েছি বুথফেরত ভোটারদের ওপর করা জরিপে। একদিকে এই নির্বাচনে ভোটদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোটাররা অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যার সুবিধা পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু একই সময়ে ভোটারদের এক বিরাট অংশ বলছে যে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রেসিয়াল জাস্টিস বা বর্ণভিত্তিক ন্যায়বিচার। এই বিবেচনাগুলো দলীয় ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে আছে, অর্থাৎ রিপাবলিকানদের কাছে অর্থনীতি যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, বর্ণভিত্তিক ন্যায়বিচার ততটা পাচ্ছে না কিংবা ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিই যে বড়, সেটা নিশ্চিত করেই একধরনের বিভক্ত সমাজের কথাই বলে। তবে আশার বিষয় এই যে বর্ণের অমীমাংসিত বিষয় এখন রাজনীতির মূল কেন্দ্রে—নির্বাচনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আগামী দিনে তা কোথায় যাবে, সেটাই দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সারা বিশ্বের মানুষের সামনে এখন প্রশ্ন, ফল ঘোষণার এই প্রক্রিয়া কত দিন ধরে ঝুলে থাকবে। যদি আদালতের হস্তক্ষেপ ঘটে, তবে তা নির্ভর করবে আদালত কী বলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আদালতে যাওয়ার যে হুমকি দিয়েছেন, তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে এখনই ভোট গণনা শেষ করা। কেননা, তাতে তাঁর বিজয় নিশ্চিত হয়, কিন্তু এখনো বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে লাখ লাখ ভোট গণনা বাকি। কিন্তু এর বাইরে এই গণনা প্রক্রিয়ার একটা চূড়ান্ত দিনক্ষণ আছে। সময় মেনে ভোটের ফলাফল সত্যায়নে রাজ্য আইনসভার সংশ্লিষ্টতাও রয়েছে। এই তারিখ প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন। ফলে যদিও এখন ভোট গণনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তা আছে, এগুলো দু–তিন সপ্তাহের মধ্যেই অবসান হবে। তদুপরি আগামী ১৪ ডিসেম্বর ইলেকটোরাল কলেজের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে মিলিত হয়ে তাঁদের ভোট দেবেন। এত তারিখ বদলানোর কোনো উপায় নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এর আগেই আদালতের হস্তক্ষেপ ঘটবে কি না এবং যে ফলাফল ঘোষণা করা হবে, সেটি প্রার্থীরা এবং তাঁদের সমর্থকেরা মানবেন কি না। যদি এক পক্ষও মানতে রাজি না হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র যে একধরনের সাংবিধানিক সংকটে পড়বে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ম আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।