ভাসমান যৌনকর্মীদের করোনার কাল
তাঁর সঙ্গে দেখা হলো রাজধানীর গোপীবাগে, ভাসমান যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের অফিসের একটি ঘরে, বুধবার সকালে।
ছোট্ট ঘরটার মেঝেতে পাতা বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে তিনি কাতরাচ্ছিলেন। আগের রাতে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে দয়াগঞ্জ এলাকায় কাজ খুঁজছিলেন। তিনটার দিকে র্যাব-পুলিশের সদস্যরা গাড়িতে তুলে তাঁদের যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে যান।
ঊরুতে লাঠির বাড়ি পড়েছে, গালে কয়েকটা চড়। সঙ্গে ৩০০ টাকা ছিল। অন্য মেয়েটির ঘরের পুরুষ এসে আরও ৭০০ টাকা দেন। তারপর নাকি তাঁরা ছাড়া পান।
করোনোভাইরাসের কারণে রাস্তায় নামা নিষেধ, রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি আছে—এসব কথা তিনি জানেন, কিন্তু ‘প্যাটে তো খাওন দিতে হবে!’
আটককারী একজন নাকি বলেছিলেন, ‘এক মাসের জন্য ঘরভাড়া মাফ করা হয়েছে তার পরও রাস্তায় আসিস?’ আমি বললাম, ‘আমার তো বাসা নাই। তাইলে কোথায় থাকব?’
দুর্জয়ের সঙ্গে ভাড়া ভাগাভাগি করে ঘরটিতে একটি ড্রপ-ইন-সেন্টার বা ডিআইসি চালান সংগঠনের একজন নেত্রী রিনা। এনজিও লাইটহাউস তাঁকে সহায়তা করে।
ডিআইসিতে রাতে থাকা যায় না। যাঁদের ঘর ভাড়া করার সামর্থ্য নেই, তাঁরা এখানে দিনটা কাটান। রাত কাটে রাস্তায়।
তিন বেলা খাওয়ার জন্য রিনা দেড় শ টাকা নেন। মার খাওয়া মেয়েটি সেদিন শুধু দুপুরের জন্য ৫০ টাকা দিতে পেরেছেন। রান্নাঘরে ছোট হাঁড়িতে সাদা ভাত ফুটছে।
রিনা নিজেও এই পেশায় আছেন। বললেন, বাড়িওয়ালা ভাই বলেছেন, যৌনকর্মীরা ‘ইন টোটাল ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী’। তাঁদের এখন আসা চলবে না। তাই দিনের আশ্রয়কেন্দ্রটি ২১ থেকে ২৭ মার্চ বন্ধ রেখেছিলেন।
কিন্তু রিনার নিজের কিছু আয় দরকার, মেয়েদেরও বিরামের জায়গা দরকার। তাই ২৮ মার্চ এটা খুলে দেন। সেদিন চারজন মেয়ে আসেন। খেয়েছেন মাত্র একজন।
তাঁদের কাছে টাকা ছিল না। তা ছাড়া, রিনারও বাজারের টাকায় টান পড়েছে। তিনি নিজে রাতে কাজে বেরোনোর ঝুঁকি নিচ্ছেন না। তাঁর মোবাইলে আরেকটি মেয়ের পায়ে আঘাতের ছবি দেখলাম।
হিসাবের খাতা খুলে আমাকে রিনা দেখালেন, করোনা-আতঙ্কের মধ্যেও বন্ধের আগ দিয়ে দিনে ১৩-১৪ জন মেয়ে খেয়েছেন। আর আমি সেদিন ডিআইসিতে সাকল্যে দুজনকে পেলাম।
একজনর পায়ে লাঠির বাড়ির কথা তো লিখলাম। অন্যজনের নাম বিলকিস। তাঁর চোয়ালে মলম মাখা। বললেন, ‘পাবলিক’ ঘুষি মেরেছে। কেউ বের হয় না, তিনি কেন বেরিয়েছেন তাই।
রিনা থাকেন মুগদায়, এক ফ্ল্যাটবাড়ির একটি ঘরে। দুই ছোট ছেলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ছে। টাকা দিয়ে একজনের কাছে রেখে কাজে বেরোন। মৃত ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য গ্রামে টাকা পাঠান। খরচ কম নয়।
গত ২৯ মার্চ দুর্জয়ের সহসভাপতি চুমকির সঙ্গে রিনার বাসায় যাই। গলিতে পাড়ার ছেলেরা লাট্টু ঘোরাচ্ছে, ক্রিকেট খেলছে। ফ্ল্যাটবাড়িটার সিঁড়িতে রেলিং বসেনি। ঘরের ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা।
আরও কম ভাড়ার ঘর আছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় কাজ করা মেয়েদের অনেকে তাই মুগদায় থাকেন।
চুমকি এখন আর যৌনকাজ করেন না। স্টেডিয়ামে একটা ভাতের দোকান ছিল। উচ্ছেদ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে তাঁর বাঁ হাত ভেঙেছে। অভাবে আছেন।
এই নেত্রী বললেন, মেয়েরা দিন এনে দিন খায়, সঞ্চয় নেই। তাঁর নিজেরও নেই। রিনা নাকি হাজারে ২০০ টাকা সুদে কিছু টাকা ধার করেছেন।
দুজনই বললেন, এ পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য মেয়েরা পাননি। কিছু চালডাল সাহায্যের ব্যবস্থা একান্ত দরকার। আর ভাড়া মওকুফের নিশ্চয়তা লাগবে। তবে ঘরই নেই, এমন মেয়েও কিন্তু কম নয়।
ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যাটা কত বড়? বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘেঁটেঘুঁটে দেখছি, দেশে যৌনকর্মীর মোট সংখ্যা অন্তত ১ লাখ হবে। আর এনজিও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সেড) ২০১৭-১৮ সালে জরিপ করে বলেছিল, ১১টি যৌনপল্লিতে প্রায় ৪ হাজার মেয়ে কাজ করেন।
১ এপ্রিল একটানে গোপীবাগের ডিআইসি থেকে চলে গিয়েছিলাম মিরপুরে শাহ আলীর মাজার এলাকায়। ঘরহীন যৌনকর্মীদের খুঁজে পাইনি। তবে মাজারের পেছনে গরিব এলাকায় টিনের ঘরে থাকা বেশ কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে কথা হলো।
তাঁরা কাজ করেন সংসদ ভবন এলাকায়। ২০ মার্চের পর থেকে বেরোচ্ছেন না কাকলি। ১৫ কেজি চাল কিনে রেখেছিলেন। আরও কয়েক দিন তাতে চলবে। বললেন, ‘কত দিন আর এই আজাব থাকবে, আল্লায় তো রহমত করবেই।’
সেদিন কাকলি ১০০ টাকা ধার করে বাজার করেছেন। বেগুন দিয়ে তেলাপিয়া মাছ রেঁধেছেন। আমাকে দুপুরে খেতে দাওয়াত দিলেন। রেখা পোড় খাওয়া মেয়ে। তিনি কিন্তু অতটা আশাবাদী না।
রেখা ২২ মার্চ থেকে কাজে যান না। করোনার ভয়ে খদ্দেরও নেই। ঘরে চাল যা আছে, কাল দুপুর পর্যন্ত চলবে। হাতে টাকা নেই। বাড়িওয়ালা ময়লার বিলের ৫০ টাকা চাইছেন। ১৫ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিতে বলছেন।
করোনার কালে যানজট নাই। ৩১ মার্চ আমি সোজা চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জে। এই শহরের যৌনকর্মীদের সঙ্গে আমার পরিচয়ের শুরু টানবাজারে, ১৯৯৭ সালের বন্যার সময়। দুই বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় সেই যৌনপল্লিটি উচ্ছেদ হয়ে গেলে যোগাযোগ বাড়ল। উচ্ছেদ হওয়া কাজল আক্তার আমার বোন হয়ে গেল।
সে সময় নারী আন্দোলন, কিছু এনজিও আর সাংবাদিকদের সহযোগিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাসমান হয়ে পড়া মেয়েরা গড়েছিলেন অক্ষয় নারী সংঘ। কাজল নিজের জীবন নিয়ে লড়েছে। এখন সংগঠন নিয়েও দাঁত কামড়ে লড়ে চলেছে।
সে এখন যৌনকর্মীদের জাতীয় মোর্চা সেক্স-ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশের সভাপতি। ফোনে কাজল বলেছিল, ইউএনএইডসের সহায়তায় চলা সরকারের এক প্রকল্পের সঙ্গে নেটওয়ার্কের একটি কাজের কথা চলছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেটা স্থগিত হয়ে গেলে সেটার জন্য বরাদ্দটি ত্রাণের জন্য পাওয়া গেছে।
নেটওয়ার্কে আছে ২৯টি সংগঠন। এই তহবিল ২৩টি সংগঠনের মধ্যে ১০ হাজার টাকা করে ভাগ করে দেওয়া হয়। যৌনপল্লির ১০টি বাদে বাকিগুলো ভাসমান যৌনকর্মীদের সংগঠন।
কাজল অক্ষয়েরও সভাপতি। ওদের অফিসে পৌঁছে দেখি, তিন কেজি চাল, অল্প ডাল, আলু আর একটি সাবান পেতে ৩৫ জন মেয়ে বসে আছেন। সংগঠনের সদস্য ৩৫০ জন। ত্রাণের জন্য সবচেয়ে অভাবীদের বাছাই করা হয়েছে।
তাঁদের কেউ কেউ রাস্তাতেই থাকেন। কোলে-কাঁখে ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছেন বেশ কয়েকজন। সদস্যদের শিশুসন্তানের সংখ্যা ১০০ ছাড়াবে।
কাজল বলল, যৌনপল্লিগুলোও বন্ধ। পর্যাপ্ত নয়, তবে সেখানে প্রশাসন কিছু সাহায্য দিচ্ছে। কিন্তু ভাসমান যৌনকর্মীরা একেবারেই নিঃসহায়। তাঁদের বাচ্চাদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ।
রোজিনা চার ছেলে আর মাকে নিয়ে থাকেন। স্বামী ‘গেছে গা’। ১২ বছর বয়সী বড় ছেলে মিশুক চালাত। পুলিশ টায়ার ভেঙে দেওয়ার পর থেকে সে ভয়ে আর বেরোচ্ছে না।
রোজিনা নিজে গত রাতে বেরিয়ে ১২০ টাকার কাজ করেছেন। তারপর পুলিশ মেরেধরে দৌড়ানি দিলে ঘরে চলে গেছেন। করোনাভাইরাস সম্পর্কে তাঁর ধারণা জানতে চাই। তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ! আমাদের কাজকর্ম বন্ধ। চাইলটাইল নাইকা। ভাড়া লইয়া বাড়িওয়ালার লগে চিল্লাচিল্লি।’
এরই মধ্যে কাজলের কাছে ফোন আসে, ১০-১২ জন মেয়ের অবস্থা একেবারে খারাপ। কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। পাশের ঘরে ত্রাণ দিচ্ছে, কিন্তু তাদের নয়, ‘মনে করে যৌনকর্মীদের অনেক টাকা। আসলে যে কোনো টাকা নাই, এইটা মানুষ বিশ্বাস করে না।’
ফাতেমা তাঁর বুড়ো মা-বাবাকে নিয়ে থাকেন। ভাইয়েরা ত্রাণ পেয়েছেন, তাঁরা কিছু পাননি। শাক টুকিয়ে বিক্রি করে দিন চালাচ্ছেন। করোনার ভয় তো আছে। কিন্তু কাজ নেই, এই হাহাকার সবার মুখে।
কাজল আমাকে গায়ে গায়ে লাগানো ফলপট্টি, ১ নম্বর রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল আর বাসস্ট্যান্ড এলাকা দেখাতে নিয়ে যায়। রাস্তার মেয়েদের কাজের সবচেয়ে বড় একটা জায়গা ছিল এটা।
বিরান হয়ে পড়া এলাকায় ধুলা-ময়লার ওড়াউড়ি দেখি। অনেক মেয়ে আনাচ-কানাচেই থাকে। দেখা হয়ে যায়। আজকে লিখতে বসে অনেকগুলো মুখ আর কথা মনের মধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকায় ডিআইসিতে বিলকিস বলেছিলেন, ‘একটা পাখি যে সারা দিন ওড়ে, রাইত হইলে ঘরে থাকে। কিন্তু আমরা সেই জিনিসটা পাই না।’ তিনি বলেছিলেন, রোগের ভয় তাঁদেরও আছে। তাঁদের যেকোনো একটা জায়গায় রেখে দিনে একমুঠ ভাত দিলে তাঁরা নিরাপদে থাকতেন।
রোজিনা ‘দানখয়রাত’ করা মানুষের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তারা আমাদের দিকে একটু তাকাক। আমরাও তো মানুষ!’ কাজলের আবেদন ছিল সরকারের কাছেও, ‘যৌনকর্মী না, মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে আইয়া দাঁড়াক।’
কথা বলতে পারেন না, তাই সবাই তাঁকে ডাকে বুবি। থাকেন রেলস্টেশনে। আমাকে দেখে তিনি ছুটে এসে সেলাম করেন, জোরে তুড়ি বাজান, নীল মুখঢাকার ওপর হাত নিয়ে উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দেন। বুঝতে পারি, তিনি আমার মন গলাতে চাইছেন। যদি একটু দয়া হয়!
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা: সাংবাদিক
আরও পড়ুন:
করোনাকালে দেশে ফেরা প্রবাসীদের কথা