শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের অনেক গল্পই একসময় শুনেছি। রূপকথার মতো লাগত। বোর্ডে যারা প্রথম হতো কিংবা মেধাতালিকায় যাদের নাম আসত, তাদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহ হতো। তারা কীভাবে পড়ে, কী খায়, কখন ঘুম থেকে ওঠে, কী পছন্দ করে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের আগ্রহ সব সেলিব্রিটিদের নিয়েই সারা দুনিয়ায় রয়েছে। হোক সে সিনেমার নায়ক-নায়িকা, ফুটবলার, ক্রিকেটার বা মুষ্টিযোদ্ধা। প্রথম আলোরই এক অনুষ্ঠানে একবার সমবয়সী এক শুটিং সেলিব্রিটির অটোগ্রাফ নিতে মেধাবী ছাত্রদের কী আগ্রহ! আবার জনপ্রিয় পদার্থবিদ আলী আসগরের সঙ্গে স্বনামধন্য একটি কলেজের ফাঁকা অডিটরিয়ামে বিজ্ঞান উৎসবের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ৩০-৪০ মিনিট নিরুত্তাপ বসে আছি, হঠাৎ দেখি ছাত্রদের মাঝে আনন্দের জোয়ার। কী হলো কী হলো? এক ক্রীড়া ধারাভাষ্যকারের শুভাগমন হয়েছে। ছাত্ররা কে কার আগে ছবি তুলবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। এই কলেজের ছাত্ররা অত্যন্ত মেধাবী। তাদের বেশির ভাগই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হবে। বিজ্ঞানই তাদের জীবিকা। কিন্তু স্বনামধন্য পদার্থবিদকে নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই!
মানুষ যে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব তা কিন্তু তার হাত, পা, নাক, কান, চোখ কিংবা দৈহিক শক্তির জন্য নয়। মস্তিষ্কের শক্তিতেই সে শ্রেষ্ঠ। শত অনুশীলনেও দৈহিক সক্ষমতা ৩–৫ গুণের বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। উসাইন বোল্ট আমাদের চেয়ে তিন গুণ জোরে দৌড়াতে, সের্গেই বুবকা আমাদের তিন গুণ উচ্চতায় লাফাতে বা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটি আমাদের তিন গুণ বেশি ওজন ওঠাতে পারবে না। একজন আইনস্টাইন কিন্তু এমন একটি সমাধান করতে পারবে, আমরা ১৭ কোটি বাঙালি মিলেও যা পারব না! উপরন্তু, অঙ্গপ্রধান অন্য যেকোনো নৈপুণ্যের থেকে মস্তিষ্কপ্রধান নৈপুণ্য অনেক বেশি আস্থাযোগ্য। এক ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করে পরের ইনিংসেই ডাক খেতে পারে একজন ব্যাটসম্যান।
কিন্তু একজন মেধাবী ছাত্রের পক্ষে একবার ৯০ পেয়ে পরের বারই ১০ পাওয়া প্রায় অসম্ভব! মস্তিষ্কের সেই শক্তিই আমাদের কাছে কত অবহেলিত! মুষ্টিযুদ্ধ দেখে অনেকে আনন্দ পায়, খ্যাপাটে ষাঁড়ের ওপর টিকে থাকার প্রতিযোগিতা বুল রাইডিংও সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে নির্মল আনন্দ দেয়। কিন্তু বুদ্ধির খেলা দাবা দেখতে তাদের আগ্রহ নেই। দাবা ফেডারেশন আর ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের মধ্যে পার্থক্য দেখলেই বোঝা যায় মস্তিষ্ককেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে আমরা কতটা উদাসীন, অনাগ্রহী।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অবশ্যই চিত্তবিনোদন প্রয়োজন। তার জন্য জনপ্রিয় অনুষ্ঠানমালারও আয়োজন করতে হবে। তবে দেশের কল্যাণে মানুষের আগ্রহের জায়গায়ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমরা কতটা বলীয়ান হচ্ছি, তার ওপরই নির্ভর করছে, আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের অগ্রগতি। বাংলাদেশের বিশ্বমানের বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম দুঃখ করে বলতেন, আমাদের দেশে সম্মেলন করার অর্থ পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে শিক্ষায় উৎকর্ষের জন্য কর্মসূচি, প্রণোদনা, প্রতিযোগিতার নিদারুণ অভাব। অথচ প্রতিযোগিতা হলো উৎকর্ষ অর্জনের সবচেয়ে ব্যয় সাশ্রয়ী পদ্ধতি।
শিক্ষায় প্রতিযোগিতা নাকি ছাত্রদের হতাশাগ্রস্ত করে। তাই প্রতিযোগিতা আজ বিলুপ্ত। অথচ এরাই যখন ফুটবল, ক্রিকেটে ম্যান অব দ্য ম্যাচ, কিংবা গান, নাচে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না, তখন তারা হতাশায় ভোগে না! যত সমস্যা শিক্ষায়। পড়ালেখায় ভালো–মন্দ যা–ই করুক, উচ্চ কিংবা নিম্ন কণ্ঠে প্রকাশ করা যাবে না। জীবনের সব ক্ষেত্রেই সাফল্যের থেকে ব্যর্থতা বেশি। সেই ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, কৃত্রিমভাবে তাকে আড়াল করে লাভ নেই। আর আড়াল যদি করতেই হয়, তাহলে তো কোনো প্রতিযোগিতাই আয়োজন করা যাবে না।
দীর্ঘদিন বোর্ড কর্তৃপক্ষ মেধাতালিকা ছাপিয়ে আসছিল। সেই মেধাতালিকা নিয়েও আমাদের নানা অভিযোগ। তালিকায় আসা না–আসা মূল্যায়নের অসংগতির কারণেও হতে পারে। আর এই সমস্যা তো শুধু শিক্ষা নয়, সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। গানের প্রতিযোগিতায় বিচারকেরা যখন নম্বর দেন, তখন কী তাঁদের মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না? সত্য বটে দুর্নীতি করে কেউ কেউ মেধাতালিকায় চলে আসছে। হেন মানব কর্মকাণ্ড নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। দুর্নীতি এড়ানোর জন্য সেই কাজই বাদ দিয়ে দেব? বরং টেকসই দুর্নীতিমুক্ত পদ্ধতির সূচনা করা উচিত। ২০ জনের মেধাতালিকায় নাম লেখানোর জন্য হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী কত বিনিদ্র রজনী পড়ালেখা করত। এখন আর সেই প্রতিযোগিতা নেই। একে তো শিক্ষায় বিনিয়োগ জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ, তারপর যদি প্রণোদনা না থাকে, তাহলে তরুণেরা জ্ঞানার্জনে সময় ব্যয় করবে কেন?
তারুণ্যের ধর্মই হলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, কেউ দ্বিতীয় হতে চায় না। ছাত্রদের আমরা যখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করি, তারা কিন্তু সেখানে ভালো করে। বাংলাদেশের ছাত্ররা যেমন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় তথ্যপ্রযুক্তিতে মহাশক্তিধর ভারতের ছাত্রদের থেকে ভালো করছে। স্কুল–কলেজের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন পর্যন্ত হয়, যদিও তাদের পাঠ্যক্রমে প্রোগ্রামিং নেই। শুধু প্রতিযোগিতা আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে! দাবায় গোটা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ। বিশ্বনাথন আনন্দ তার ঢের পরে গ্র্যান্ডমাস্টার হন, পরে তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পর্যন্ত হয়েছেন। আমরা কিন্তু নিয়াজ মোরশেদকে যথাযথভাবে এগিয়ে দিইনি।
ধরুন, একটি ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচকে আমরা যদি নগদ এক হাজার টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করি, তাহলে কতজন সেই খেলা খেলবে? একজন ফিগো কিংবা রোনালডো ৩০ পার হওয়ার আগেই কয়েক শ মিলিয়ন ইউরো উপার্জন করে। আর তার দ্বিগুণ বয়সে পৌঁছেও একজন পাকা চুল আইনস্টাইন তার ১ শতাংশ আয় করতে পারে না! এই বাস্তবতায় কজন বিজ্ঞানী কোনোরকম প্রণোদনা ছাড়াই জ্ঞান নিয়ে ধ্যান করবে? মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিতে খেলোয়াড় কিংবা বিনোদন তারকার তুলনায় আইনস্টাইনের অবদান কি এতই কম? কোনো জায়গায় একই সময়ে নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর শাহরুখ খান উপস্থিতি হলে পদার্থবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ ছাত্রটি কি নোবেল বিজয়ীকে ধাক্কা মেরে একনজর শাহরুখ খানকে দেখার চেষ্টা করবে না? বিজ্ঞান কিংবা মেধার গুরুত্ব মেধাবীদের মধ্যেই যেখানে নেই, অন্যদের মধ্যে সেখানে কী করে থাকবে?
সাধারণ মানুষের থিওরি অব রিলেটিভিটি কিংবা কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝার কথা না, তবে সমাজপতিদের তো এর গুরুত্ব বোঝা উচিত। অলিম্পিয়াড বিজয়ীদের বছরে এক দিন হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ করেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট! ৩০০ বছর পূর্বে পদার্থ বিজ্ঞানের সব জ্ঞান নিশ্চয়ই এক হাজার পৃষ্ঠার একটি বইতে লিখে রাখা যেত। এখন ওই সাইজের এক হাজার বইতেও সব জ্ঞান আঁটানো যাবে না। সুতরাং এখন অনেক বেশি জ্ঞানকর্মী প্রয়োজন। অনেক তরুণকে জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করতে হবে।
প্রায় শত বছর পাবলিক পরীক্ষার মেধাতালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তবে কখনো কোনো ছাত্রকে জানানো হয়নি সে এই বছর কিংবা এযাবৎকালের গণিত কিংবা রসায়নে অথবা বাংলায় কিংবা ইংরেজিতে অথবা নানা বিন্যাসে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। এই রেকর্ডগুলো থাকলে ছাত্ররা ভাঙার চেষ্টা করত, প্রতিযোগিতা হতো, যা ক্রীড়ার সব ক্ষেত্রেই আছে। ১০০ মিটার দৌড়ে সামান্য সময়ের ব্যবধানে রেকর্ড হয়। সামান্যই তফাত, তারপরও কত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ শিক্ষায় এর থেকে অনেক বড় ব্যবধানকেও স্বীকৃতি দিই না। খেলার এই পরিসংখ্যানগুলো আবার মেধাবী ছাত্ররা নানা রকম কুইজ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য মুখস্থ করে!
পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো কখনো কোনো কোনো সমস্যার সমাধানে অচলাবস্থার তৈরি হয়েছে। সমাধানের জন্য যেই কোনো বিজ্ঞান একাডেমি পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সঙ্গে সঙ্গে সমাধান হয়েছে। ১৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আইএমইউতে ডেভিড হিলবার্টের দেওয়া অসমাধিত সমস্যার তালিকা কিংবা ক্লে ম্যাথমেটিকস ইনস্টিটিউটের মিলেনিয়াম পুরস্কার ঘোষণার পর অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। সুতরাং অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষায়ও পুরস্কার, প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ।
পড়ালেখার পারফরম্যান্স নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেই সমস্যা। এই শিক্ষার্থীই যখন দৌড় প্রতিযোগিতায় সর্বশেষ হয়, সেটা শুধু দর্শকই নয়, প্রতিযোগী নিজেও জানতে পারে, সেখানে সমস্যা নেই। পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে স্কুল–কলেজগুলোকে র্যাঙ্ক করা হতো। সেটাও বাদ কারণ কোনো কোনো চতুর প্রতিষ্ঠান কায়দা করে নিজেদের প্রথম বানিয়ে ফেলে। আমরা এমন নীতি প্রণয়ন করতে পারি না যেখানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ছাড়া ভালো র্যাঙ্ক পাওয়া যাবে না? নম্বর প্রাপ্তি এবং জ্ঞানার্জনের মাত্রার মধ্যে যে আন্তসম্পর্ক আছে বর্তমানে আমরা তাতে আর আস্থা রাখতে পারছি না। এই একই যুক্তিতে তো গ্রেড আর জ্ঞানার্জনের মধ্যেও আন্তসম্পর্ক থাকার কথা নয়। সুতরাং ভাবার কারণ নেই যে নম্বর থেকে গ্রেডে এসে ইতিবাচক উত্তরণ হয়েছে। গ্রেডিং সিস্টেমের কারণে চতুর্থ শ্রেণির সঙ্গে প্রথম শ্রেণির গ্রেডের পার্থক্য আর থাকছে না। উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় কিন্তু জ্ঞান ও গ্রেডের আন্তসম্পর্ক আছে। চেষ্টা করলে আমরাও এ রকম পদ্ধতির সূচনা করতে পারি।
আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলার কিছু নেই। আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই সম্মানজনক র্যাঙ্ক পায় না। আমেরিকায় সারা পৃথিবীর ৫ শতাংশ মানুষের বাস অথচ শ্রেষ্ঠ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০টিই তাদের। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্র–শিক্ষক সবাইকেই নানা সূচকে র্যাঙ্ক করছে। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নেই।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু প্রস্তাব করছি।
১. শিক্ষায় আগের মতোই সুস্থ প্রতিযোগিতার চালু।
২. গ্রেডের পরিবর্তে নম্বর পদ্ধতি চালু।
৩. প্রতি শ্রেণি ও বিষয়ে বিজয়ীদের নিয়ে নানা পর্যায়ে অলিম্পিয়াড আয়োজন।
৪. দুর্নীতিমুক্ত প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়নে জিআরইর মতো অনেক বেশি গবেষণা ও বিনিয়োগ।
৫. নানা সূচকের বিচারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী ছাত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপজেলা, জেলা ও বিভাগের নামও ওয়েবপেজে তালিকাবদ্ধ করা এবং ঘটা করে পুরস্কার প্রদান।
শিক্ষা মানুষের জীবনে অনেক কর্মকাণ্ডের একটি মাত্র। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই সবার নৈপুণ্য এক হবে না এবং তা গোপন রাখারও প্রয়োজন নেই।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো