ভারতে লকডাউনের বিপদ
যদি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়, তবে তাদের জন্য আয় সহায়তা এবং মৌলিক সেবা প্রদান জরুরি।
দুনিয়াজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার গোটা ভারতকে উভয়সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রথম সংকটটি হলো জনস্বাস্থ্যের ও অপরটি হলো অর্থনৈতিক সংকট। করোনায় ঘটা জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি এখন পর্যন্ত সীমিত (সাতজন, যেখানে ভারতে প্রতিবছর ৮০ লাখ মানুষ নানা অসুখ ও দুর্ঘটনায় মারা যায়); যদিও খবর আসছে যে মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে (সর্বশেষ খবরে মৃতের সংখ্যা ২৯ জন)। ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে অর্থনৈতিক সংকট দ্রুতগতিতে আঘাত হেনেছে। করোনার আঘাতের কারণে জনস্বাস্থ্যের সংকট শ্রেণি–নিরপেক্ষ নয়। এই অর্থনৈতিক সংকট দরিদ্র মানুষের জীবনকে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি করেছে।
ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস
সব অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, রাস্তার ফেরিওয়ালা, দিনমজুর, হকার, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক যাঁরা মোট শ্রমশক্তির বেশির ভাগ অংশই জুড়ে রয়েছেন, তাঁদের সবাই এ অর্থনৈতিক সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে গণছাঁটাইয়ের কারণে পরিযায়ী শ্রমিকেরা নিজ বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি মালিকপক্ষ কিছু শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরিও পরিশোধ করেনি। উপরন্তু, মজুরি ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে তাঁরা মাঝপথে আটকে আছেন, কারণ, ফেরার ট্রেনগুলো করোনার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এ স্থবিরতা আশপাশের প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে, কারণ; কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং শিগগিরই এগুলো আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার আশা খুব ক্ষীণ। এমনকি যাতায়াতের সাধারণ রুটগুলোও এলোমেলো হয়ে গেছে। এ ছাড়া উত্তর ভারতের লাখ লাখ খেটে খাওয়া পরিবার যে গমের ফলনের ওপর নির্ভরশীল, গম কাটার সময় ঘনিয়ে এলেও এটি তাঁদের বিদ্যমান সংকট কাটাতে খুব স্বস্তির কিছু বয়ে আনবে না। এ সবকিছুই বড়সড় বিপদের আগে ক্ষুদ্র কিছু নমুনামাত্র।
এই অর্থনৈতিক সংকট আমাদের খুবই জরুরি ও ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম আরম্ভের ডাক দিচ্ছে। লকডাউন করাটা সম্ভবত মহামারির বিস্তারের গতি কমাতে সাহায্য করবে; কিন্তু দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ ছাড়া ঘরে অলস বসে থাকা বেঁচে থাকার জন্য আরও কঠিন। তবুও যদি তাঁরা ঘরের ভেতর থাকতে বাধ্য হন, তখন তাঁদের সহায়তার দরকার পড়বে। এখানে বলা দরকার, ভারতের সঙ্গে সচ্ছল দেশগুলোর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ব্যবস্থায় বড় রকমের পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কানাডা কিংবা ইতালির কথা বলা যায়। লকডাউন হলে এসব দেশের খানাপ্রতি মজুত এমন পরিমাণ রয়েছে, যা দিয়ে কিছুকাল তারা চলতে পারবে। কিন্তু ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিনা কাজে টিকে থাকার শক্তি শূন্যের কোঠায়।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির সঠিক ব্যবহার
যেহেতু দ্রুততম সময়ে সংকট ঘনীভূত হয়ে আসছে, প্রথমেই দরিদ্রদের জন্য যে কাজটি করতে হবে, তা হলো চলমান সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কর্মসূচির কার্যকর ও এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে পেনশন, পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস), মিড ডে মিলস এবং মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (এমজিএনআরইজিএ) উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পেনশনের অর্থ অগ্রিম ছাড় করা, পিডিএসের রেশন সুবিধার পরিসর বর্ধিতকরণ, এমজিএনআরইজিএর অধীনে সব বকেয়া মজুরি অনতিবিলম্বে ছাড়করণ এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের রেশন বাসায় নেওয়ার সুবিধা ও এর আওতা বাড়ানো। কিছু কিছু রাজ্য এ ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই গ্রহণ করলেও আদতে বিদ্যমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সহায়তার পরিধি অনতিবিলম্বে ব্যাপকভাবে বাড়ানো দরকার। আর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কার্যত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে হবে। ফলত, এটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারের সম্ভাব্য বেইল-আউট দিয়ে সম্পদের অপচয় থেকে বাঁচার একটি পথ হতে পারে। শিগগিরই যেসব খাত এ সংকটের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তারা সরকারের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করবে তাদের বিশেষ কিছু সুবিধা প্যাকেজ আদায় করার জন্য।
এদিকে জরুরি সেবাসমূহ বন্ধ করে দেওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা জনসাধারণের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে দেবে। এগুলোর মধ্যে গণপরিবহন, প্রশাসনিক অফিস, আদালতে মামলার শুনানি, এমজিএনআরইজিএর প্রকল্পগুলো, এমনকি রোগ প্রতিরোধক টিকা প্রদান কেন্দ্রগুলোও অনেক রাজ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব আদেশ কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই সঠিক থাকলেও অন্য সিদ্ধান্তগুলো হিতে বিপরীত হতে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আমরা কেবল স্বাস্থ্যগত সংকটই মোকাবিলা করছি না, বরং অর্থনৈতিক সংকটেও আমরা পড়েছি। যদি আমরা জনসাধারণের প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা তুলে নিয়ে ভাইরাসজনিত স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষমও হই, তবু এসবের অর্থনৈতিক ফলাফল আমাদের বিবেচনায় রাখা জরুরি।
নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে যেসব আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এ ধরনের প্রতিরোধী সতর্কতামূলক পদক্ষেপের দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যখন একজন ঘরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এটিকে সম্ভাব্য দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো আত্মরক্ষামূলক ও দ্বিতীয়টি হলো জনকল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথম দৃষ্টিকোণটি মানুষ গ্রহণ করে, কারণ সে নিজেকে সংক্রমিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে চায়। আর দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণের কারণ হলো একজন সামষ্টিক প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করতে চায়, যাতে ভাইরাসটির বিস্তার বন্ধ করে দেওয়া যায়।
কিছু লোক আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আত্মরক্ষার জন্য। কিন্তু এ ধরনের চিন্তার মানুষ বুঝতে পারে না যে একজন ব্যক্তির কেবল নিজের সংক্রমণের সম্ভাবনা কম এবং এর থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা এতই সামান্য যে তার আত্মরক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থাও আদতে তেমন কোনো বড় ব্যাপারই নয় (এ ক্ষেত্রে পেশাজীবী জনগোষ্ঠী, যেমন: ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য এ কথাটি প্রযোজ্য নয়)। ভারতে প্রতিবছর যক্ষ্মায় প্রায় ৪ লাখ মানুষ মারা যায়, তবুও এটির সংক্রমণ ঠেকাতে কোনো বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। সুতরাং, কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে পর্যন্ত মাত্র সাতজনের (সর্বশেষ খবরে মৃত মানুষের সংখ্যা ২৯) মৃত্যুতে কেন আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো? এর কারণ এটি নয় যে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে চাইছি, বরং এটির আসল কারণ হলো আমরা মহামারি ঠেকাতে চাইছি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
সৃজনশীলতা প্রদর্শন
মহামারি ঠেকানোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার এই যুক্তিতে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে জনসাধারণের সেবাগুলোকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছে সরকারি কর্মজীবীদের আত্মরক্ষা তেমন কোনো বড় বিষয় নয় (অন্তত কিছু সময়ের জন্য), বরং মূল বিবেচ্য ছিল জনস্বার্থ। অধিকন্তু, জনস্বার্থ-চিন্তা সবকিছু বন্ধ রাখার অর্থনৈতিক ফলাফলকে বিবেচনায় নেওয়া অবশ্যকর্তব্য। যদি কোনো জনসেবা খোলা রাখায় জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়, তবে অবশ্যই জনস্বার্থেই সেটি বন্ধ করা দরকার (এ কারণেই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে)। অন্যদিকে, যেসব জনসাধারণের সেবাসমূহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেশি প্রয়োজন, সেগুলো খোলা রাখা অত্যন্ত জরুরি যদি তা জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি না বাড়ায়। এটি কেবল জনস্বাস্থ্য সেবা কিংবা পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের বিষয়ই নয়, বরং অন্য অনেক সরকারি সেবা সচল রাখার বিষয়ে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, জেলা পর্যায়ে ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড। দরিদ্র জনগোষ্ঠী এসব সেবার প্রতি নানাভাবে নির্ভরশীল। এই মুহূর্তে দেশের সব জায়গায় এসব সেবা একযোগে বন্ধ রাখা অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যাবে, যদিও এগুলো চালু রাখলে এতে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি খুব বেশি বাড়ত বলে মনে হয় না।
এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি সেবাসমূহ খোলা রাখার জন্য কিছু উদ্যোগ ও সৃজনশীল ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এ সময় যেসব সরকারি সেবা পাওয়া যাবে, তার তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে (কিছু রাজ্যে এ তালিকা প্রকাশও করা হয়েছে)। কর্মক্ষেত্রে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়ের তালিকা প্রকাশ করে এটির শুভসূচনা হতে পারে। অনেক সরকারি অফিস-আদালতে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে কর্মপরিবেশ সৃষ্টির জোর দাবি রয়েছে। এ সময়ে কিছু কিছু সেবা আমরা পুনরাবিষ্কার করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের গ্রামে শিশু যত্ন কেন্দ্র অঙ্গনওয়াড়ির কথা বলা যায়। এটি এ সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র হতে পারে, যদিও শিশুদের এ সময়ে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। আরও অনেক ধরনের জনপরিসর রয়েছে, যা এ সময়ে ব্যবহার করা যায় প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা রেখে। ফলে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও হাত ধোয়ার মতো ভালো অভ্যাস জনগণের মধ্যে নতুন করে গড়ে তোলা যায়।
একটি কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, যা আমাদের সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। যেভাবে সবকিছু এখন চলছে সেভাবে চলতে থাকলে অনেক রাজ্যের সরকারের পক্ষে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম চালানো সম্ভবপর হবে না কিংবা জনগণের বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুব্যবস্থাও সমস্যায় পড়বে। আর যদি তা ঘটে তবে, তা আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে। তখন এটি কেবল আর অর্থনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করেই ছাড়বে না, বরং স্বাস্থ্য সংকটকেও আরও গভীরতর করে তুলবে। আর সেটি ঘটলে ভারতের দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কর্মসূচি পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। এমনতর সময়ে আমরা ভারতে এটি ঘটতে দিতে পারি না।
জঁ দ্রেজ: রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অতিথি অধ্যাপক।
(লেখাটি অনুবাদ করেছেন আহমেদ জাভেদ, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি।)