মমতা ২০২১-এ ভারতবাসীকে দুটি বার্তা দিলেন। প্রথম বার্তা, আরএসএস-বিজেপি কোনো অজেয় শক্তি নয়। দ্বিতীয় বার্তা, মহাশক্তিধর এই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হারাতে কোনো রাজ্যে বহু দলের গণজোটও জরুরি নয়।
মমতার এই বার্তা বেশি সাড়া ফেলেছে উত্তর প্রদেশে। যেখানে রয়েছে ভারতের লোকসভার সর্বোচ্চ ৮০টি আসন, যা পুরো লোকসভার ১৫ শতাংশ। উত্তর প্রদেশের মতোই তৃণমূলের ভূমিধস বিজয় বিশেষভাবে ভরসা পেল পাঞ্জাব থেকে ওডিশা উত্তর-দক্ষিণের সব আঞ্চলিক দল।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা হিস্যায় ভারতে ৭ ভাগ। ভূমির হিস্যায় আরও কম—মাত্র ৩ ভাগ। কিন্তু এই রাজ্য থেকে ৩০ ঘণ্টা আগে যে বার্তাগুলো গেল, তা ১৩৯ কোটি ভারতবাসীকেই কমবেশি ঝাঁকুনি দিয়েছে।
মমতার কৌশল উজ্জীবিত করছে আঞ্চলিক দলগুলোকে
ভারতের এ মুহূর্তের কেন্দ্রীয় শাসক পরিবার আরএসএসের জন্ম ১৯২৫ সালে। সেই দলেরই বড় সন্তান বিজেপি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন রাজনৈতিক শক্তি তারা। এশিয়ায় এত পুরোনো এবং ও রকম শক্তিধর পার্টির তুলনা চলে কেবল গণচীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। এই দুই দল মিলে বিশ্বের প্রায় আড়াই শ কোটি মানুষ শাসন করছে। উভয় দলেরই সদস্যসংখ্যা কোটি কোটি। এ রকম শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়েই আরএসএস চার বছর পর শত বছর পূর্তি উৎসব করতে যাচ্ছে। সেই আরএসএস-বিজেপি পরিবার তার শক্তি-সামর্থ্যের পুরোটা নিয়ে এসেছিল ২০২১-এর বাংলা-অভিযানে। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ পুরো অভিযানে আরএসএস বাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একক জেদ আর সাহসে সেই অভিযানকে থামিয়ে ভারতজুড়ে তুমুল বিস্ময়ের জন্ম দিলেন মমতা। রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা তাঁর শক্তির জায়গা বুঝতে নেমেছে এখন। আর ভারতজুড়ে আঞ্চলিক দলগুলো খুঁজছে এর মাঝে যার যার ভবিষ্যতের কৌশল।
আরএসএস একটা ক্যাডারভিত্তিক দল। তার ক্যাডারদের মুখ্য অস্ত্র হিন্দুত্ববাদ। ৭১ শতাংশ হিন্দুর রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এবং ৮০ শতাংশ একই ধর্মাবলম্বীর ভারতে এ রকম এক শক্তিশালী অস্ত্রধারী বিশাল আয়তনের ক্যাডারভিত্তিক অভিযানকে মোকাবিলা সহজ নয়। মমতা তাতে বিকল্প রাস্তা দেখিয়েছেন। তিনি সরাসরি সংঘাতে হাজির হলেন মূলত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা নিয়ে। আরএসএস যে অভিযানকে পার্টি-পার্টি যুদ্ধে পরিণত করেছিল মমতা তাকে ক্যাডার রাজনীতি বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়ে সামলেছেন। ঠিক এখানেই সম্ভাবনা দেখছে ওড়িশা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, আসামের মতো রাজ্যের আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদীরা। তারা এখন দ্রুত আঞ্চলিক ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোতে সংঘবদ্ধ হওয়াকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বাড়তি গুরুত্ব দেবে, যা চলতি ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক ছক পাল্টে দিতে পারে।
ভারতের রাজনীতিতে সদ্য যুক্ত হওয়া এই ‘মমতা মডেল’ একই সঙ্গে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের জন্য সাংগঠনিক ও আদর্শিক সংকটও তৈরি করেছে।
বিজেপির সামনে দুটি সংকট হাজির হলো
‘মমতা মডেলে’ বিজেপির জন্য সংকটের জায়গা দুটো। হিন্দুত্ববাদ যে হিন্দুসমাজকে ভোটবাক্সে নিয়ে আসার একমাত্র অস্ত্র হতে পারে না, মমতা সেটা প্রমাণ করেছেন। বিজেপির লোকজন বলছে বটে, মমতা মুসলমান ভোট পেয়ে জিতেছেন—কিন্তু কথাটা সত্য নয়। ২৭ শতাংশ মুসলমানের রাজ্যে প্রায় প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট পেল তৃণমূল। সহজেই বোঝা যাচ্ছে বিপুল হিন্দু ভোটও পেয়েছেন মমতা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে হিন্দুরা বিজেপির পুরোনো একক রাজনৈতিক পণ্যটিকে আর নিচ্ছে না—যদি তাদের বিকল্প কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক সাহসে উদ্দীপ্ত করা যায়। অথচ বিজেপির হাতে সে রকম কোনো বিকল্প আদর্শিক অস্ত্র আর নেই। মসজিদ-মন্দিরের রাজনীতি এবং মুসলমান-খ্রিষ্টান বিদ্বেষ প্রতিপক্ষের নতুন কোনো কৌশলের সামনে যে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে বিজেপি আদৌ সেভাবে প্রস্তুত ছিল না।
দ্বিতীয়ত, বিজেপি ও আরএসএস অমিত শাহের নির্বাচনী প্রকৌশলবিদ্যাকে চ্যালেঞ্জ–অযোগ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করেছিল, যা কংগ্রেসসহ বহু বিরোধী দলের নেতারাও বিশ্বাস করতে শুরু করেন। মমতা সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন সঠিক রণকৌশল গ্রহণ করে যেকোনো রাজনৈতিক শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টে অসমযুদ্ধেও জেতা যায়। সঠিক রণকৌশল নেওয়া হলে নির্বাচন কমিশন, মিডিয়া, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর বৈরিতা এবং অর্থশক্তিতে দুর্বল থেকেও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মাটিতে নামিয়ে আনা যায়। জরুরি হলো আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে বুঝে সরাসরি মেঠো জনসংযোগ। মমতার এই কৌশল এখন থেকে বিজেপিবিরোধী আঞ্চলিক দলগুলো রাজ্যে রাজ্যে অনুসরণ করবে বলেই অনুমান করা যায়।
মমতা মডেল আঞ্চলিক দলগুলোর কাছে কংগ্রেসের আবেদন কমাবে বিজেপিকে মোকাবিলায় রাজ্যে রাজ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সঙ্গে নেওয়ার অপরিহার্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এর বড় প্রমাণ এবারের আসামের নির্বাচন। আসামে এনআরসি নিয়ে বিজেপি অসমিয়াদের মাঝে এবার অত্যন্ত অজনপ্রিয় অবস্থায় ছিল। যেকোনো আঞ্চলিক দল মমতার মতো অসমিয়া জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিলে আসামের নির্বাচনী ফল ভিন্ন হতে পারত।
হিন্দুত্ববাদকে পুরোনো ধাঁচে সেকুলার অবস্থান দিয়ে মোকাবিলার লক্ষ্যে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিরোধী জোট এনআরসিবিরোধী অসমিয়া ক্রোধ থেকে ফায়দা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া কংগ্রেস জোটবদ্ধ হওয়ার সময় অনেক আসন নিয়ে নিলেও প্রচারণায় ও জনসংযোগে তাদের সে রকম কোনো শক্তি–সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটাতে পারেনি। বরং বদরুদ্দীন আজমলের মতো তাদের আঞ্চলিক ছোট শরিকেরা সামান্য আসন পেয়েও ভালো হিস্যায় বিজয়ী হয়ে আসতে পেরেছে। মূলত কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণেই আসামে বিজেপিবিরোধী শিবির জেতেনি এবার।
পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগে বিহারের নির্বাচনেও কংগ্রেসের নির্বাচনী ব্যর্থতার কারণে বিজেপি জোটকে পরাস্ত করা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গে মমতার নির্বাচনী কৌশলের আলোকে বিহার ও আসামের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট দেখাচ্ছে, রাজ্যে রাজ্যে বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে মৈত্রী ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনছে না। কংগ্রেসের রাজনীতির আঞ্চলিক আবেদন কমে গেছে। তার চেয়ে মমতার মতো করে একক দলের আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী অস্ত্র হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে বেশি কার্যকর। এই বার্তা, রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের প্রতি আঞ্চলিক দলগুলোর আগ্রহের সমাপ্তি ঘটাতে পারে শিগগিরই।
বিকল্প হিসেবে কেরালার পিনারাই বিজয়ন, পশ্চিমবঙ্গে মমতা, তামিলনাড়ুর স্ট্যালিন, দিল্লির কেজরিওয়াল, মহারাষ্ট্রের শারদ পাওয়ার, উত্তর প্রদেশের মায়াবতী ও অখিলেশ যাদব, ওড়িশার বিজু পট্টনায়েক, বিহারের লালু প্রসাদ যাদব, কাশ্মীরের আবদুল্লাহ প্রমুখ ব্যক্তিরা বিজেপিবিরোধী নতুন ধাঁচের জাতীয় জোট হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন ধীরে ধীরে। এ রকম রাজনীতিবিদদের সহকর্মীরা মমতার সর্বশেষ বিজয়ে তাঁদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিঃশেষ না হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনারাই বিজয়ন ও স্ট্যালিন ইতিমধ্যে এ রকম জোটের জন্য একটা অনানুষ্ঠানিক ভরসা হয়ে গেছে।
অর্থাৎ ভারতজুড়ে মোদির ব্যক্তিত্বের উত্তাপ মোকাবিলার মতো কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে পাওয়া গেল—যাঁরা রাহুল গান্ধীর চেয়ে শক্তিশালী ইমেজে হাজির হতে পেরেছেন এবং যাঁদের একমাত্র অস্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। মমতা মডেল এভাবে ভারতে এ মুহূর্তে মোদিবিরোধী শিবিরের জন্য অক্সিজেনের এক খনি হিসেবে হাজির হয়েছে, যখন সিলিন্ডার-অক্সিজেন দিতে না পেরে কেন্দ্র সরকার অভূতপূর্ব এক নাজেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। মমতা, বিজয়ন এবং স্ট্যালিন ত্রয়ীর সামনে এখন অবশ্যই প্রধান সমস্যা কোভিড—মোদি নন। কিন্তু কোভিডের রেশ কাটলেই মহামারি মোকাবিলায় বিজেপি সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে ভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলোর যৌথ অবস্থান দেখা যেতে পারে।
আঞ্চলিক রাজনীতির এই উত্থান সামলাতে হলে মোদি এবং রাহুল গান্ধী উভয়কেই নিজ নিজ দলে বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। যার তাৎপর্য হবে দ্বিমুখী। রাজ্যগুলোয় মোদি, অমিত শাহ, রাহুল গান্ধীর মতো ব্যক্তিদের নির্বাচনী সমাবেশের মাধ্যমে ভোট সংগ্রহের কার্যকারিতা কমে যাবে। গুরুত্ব বাড়বে অঞ্চলভিত্তিক কলাকৌশলের এবং অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক তারকাদের।
ফেডারেল ভারতের দাবি শক্তি পেল ঘাসফুলের বিজয়ে
মমতার ঘাসফুল মার্কার বিজয় ভারতে প্রকৃত একটা ফেডারেল ব্যবস্থার আবেদনও অনেক বাড়িয়ে তুললে, যা পুরো দেশের ওপর উত্তর ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে বহুদিন পর আবার চ্যালেঞ্জ করছে। অক্সিজেনসংকট একই সময়ে অধিকাংশ রাজ্যগুলোকে হাতে–কলমে দেখাল স্বাস্থ্য, খাদ্য ইত্যাদি বিষয়ে স্বনির্ভর ব্যবস্থা গড়ে না তুলে কেন্দ্রমুখী হয়ে থাকায় তারা বিপদগ্রস্ত। হঠাৎ সৃষ্ট এ রকম এক নির্মম অভিজ্ঞতা ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেই ভারতজুড়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সামাজিক আবেদন বাড়িয়ে তুলেছে ইতিমধ্যে। মানুষের এ রকম মনোভাবের সম্পূরক রাজনীতিই মাঠে এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুদ্ধকৌশলে। ‘বাংলার মেয়ে’ সেই সূত্রে এখন সমগ্র ভারতের সম্ভাব্য নেত্রী হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছেন।
‘এক দেশ এক জাতি’র যে স্লোগানে বহু সংস্কৃতির ভারতকে আরএসএস-বিজেপি এত দিন বাঁধতে চেয়েছে সেই জবরদস্তির বিকল্প দেখালেন মমতা। প্রতিটি প্রান্তিক রাজ্যের সাংস্কৃতিক নিজস্বতার শক্তিই ফুটে উঠল মমতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক