ব্যাংককের পরিচ্ছন্নতা, নীরবতা

৭০ লাখ জনসংখ্যা–অধ্যুষিত ব্যাংকক শহর অসাধারণ ব্যস্ত। ফুটপাতে অগণিত দেশি-বিদেশি মানুষের চলাচল। আন্তর্জাতিক ডেইরি সম্মেলনে সম্প্রতি ব্যাংককে সাত দিনের অবস্থানে অনুভব করেছি অদ্ভুত নীরবতা, নিস্তব্ধতা। নেই শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ। ফুটপাতে-রাজপথে নেই একবিন্দু মলমূত্র বা থুতুর দূষণ। রাস্তার পাশে শত শত ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান অথচ কোনো দোকানি বা ক্রেতাকে থুতু বা পলিথিন ফেলতে দেখা যায়নি। এশীয় এ শহরটির পরিচ্ছন্নতা রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব শহর ও নগরবাসীর জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ফুটপাতে সারি সারি দোকান অথচ মানুষের নিরবচ্ছিন্ন পথ চলাচলকে অবরুদ্ধ করা হয়নি। হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। নিজ নিজ পেশা, ব্যবসা ও কাজে দৌড়াচ্ছেন কিন্তু কোনো হইচই নেই। অসাধারণ ব্যস্ততায় মুখর অথচ আশ্চর্য শান্ত এক শহর।
এখানকার মানুষ প্রচণ্ড কর্মপাগল, পরিশ্রমী। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের লাখো লাখো পর্যটক থাইল্যান্ডকে প্রাণবন্ত রাখেন। ব্যাংকক ইউরোপীয় কোনো শহর না হয়েও এখন অভাবনীয় উন্নতির শিখরে। নগরের কোনো কোনো অংশের পরিচ্ছন্নতা ও নীরবতা ইউরোপীয় শহরগুলোর সমতুল্য। নগরবাসীর মধ্যে থুতু ফেলার সংস্কৃতি নেই। খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি এটা। অথচ ঢাকার অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে সর্বত্র থুতু ফেলার কী বিশ্রী প্রবণতা! শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, এ নোংরা অভ্যাস অনেকের মধ্যে সংক্রমিত। শীতকালে কফ-থুতুর রাজত্বে ঢাকার রাস্তায়-ফুটপাতে পথচলা দায়। অথচ হাজারো রোগ-জীবাণুর বাহক এ কফ-থুতু।
ব্যাংকক শহরের ফুটপাতে প্রত্যুষ থেকে রাত অবধি রকমারি খাবার বিক্রি হয়। এখানকার কর্মজীবীরা রান্নার সময় পান না। গৃহস্থালি রান্নার অবকাশ খুবই কম। এমনকি ইদানীং নতুন অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে রান্নাঘরই রাখা হচ্ছে না। প্রতিটি দোকানি প্লাস্টিক-পলিথিনে যার যার বর্জ্য সংরক্ষণ করছে এবং যথাসময়ে ও যথাস্থানে এ বর্জ্য চলে যাচ্ছে পুনঃ চক্রায়ন–প্রক্রিয়ায়। খাবার বিক্রির সময় সবার হাতেই গ্লাভস পরা। ধুলাবালির যন্ত্রণা বা মশা-মাছির উপদ্রব নেই। উন্মুক্ত স্থানে প্রতিটি খাবার স্বাস্থ্যসম্মতভাবেই তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতারা শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যা-ই হোক, প্রত্যেকে ভীষণ স্বাস্থ্য ও পরিবেশ–সচেতন। ব্যাংকক শহরজুড়ে চলছে বহুতল ভবনের নির্মাণযজ্ঞ। কিন্তু অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। ভবনের ধুলা বা প্রস্তরখণ্ড মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত বা বিপন্ন করছে না। অথচ ঢাকায় আবাসন প্রকল্পের শান্তি হরণকারী উৎপাতে মানুষের রাতের ঘুম হারাম হচ্ছে। রাস্তা পারাপারের প্রয়োজন হলে গাড়ির চালকেরা দূর থেকেই পথচারীদের জন্য গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছেন। পথচারী ও গাড়ির মধ্যে প্রতিদ্বিন্দ্বতা নেই, একে অপরের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ার প্রতিযোগিতা নেই। মানুষের প্রতি মানুষের কী আশ্চর্য সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও পরিপূরকতা।
পথচারীদের হাতে হাতে পলিথিন ভরা খাবার, আইসক্রিম, স্ন্যাকস। কিন্তু কোথাও খোলা ডাস্টবিন নেই, এক টুকরা বর্জ্য নেই, নেই খোলা ড্রেন। ফুটপাতে-রাস্তায় মানুষের চলাচলে কী অনাবিল শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা! জাতিসংঘসহ পৃথিবীর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের অধিকাংশ সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের জন্য এশিয়ার সর্বোত্তম স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে ব্যাংকক শহরকে। শান্তি, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা ব্যাংকককে আকর্ষণীয় করেছে পর্যটকদের জন্য। এ কারণে থাই অর্থনীতির প্রাণ এ পর্যটন ব্যবসা। ট্যাক্সি বা গণপরিবহনেও অদ্ভুত শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা। ট্রাফিক পুলিশের লাঠির শাসন নেই। সিগন্যালেই সব নিয়ন্ত্রণ। প্রযুক্তিতেই সুরক্ষা। রাজপথে দৃষ্টান্তমূলক আইন মান্যতা এবং আনুগত্যশীলতা। রাজপথে বা ফুটপাতে হইচই, ঝগড়াঝাঁটি-উৎপাত নেই। কেউ কারও দিকে তাকানোর ফুরসত নেই।
ব্যাংকক শহরের বিশাল বিশাল অট্টালিকা, হোটেল আর আবাসন প্রকল্পের সবখানে সবুজের সমারোহ। প্রতিনিয়ত পরিবেশকে সযত্নে রক্ষা করা হচ্ছে। সর্বত্র সবুজ বৃক্ষে সাজানো কিংবা একখণ্ড শোভনীয় বাগান বা সবুজের আচ্ছাদন দিয়ে ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। নগরের সঙ্গে প্রকৃতির কী অন্তরঙ্গতা, ঘনিষ্ঠতা। কড়া রোদ অথচ দহন নেই, উত্তাপ নেই। হাস্যোজ্জ্বল প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রতিটি নাগরিকের চেহারাজুড়ে। আচরণে বিনয়-নম্রতা মুক্তার মতো ছড়িয়ে আছে। সদাচরণের সঙ্গে জুড়ে আছে নির্মল মানসিকতা। এভাবে একটি জাতি ধাপে ধাপে এগিয়ে বিশ্বমানচিত্রে তাদের ঈর্ষণীয় অবস্থানে উন্নীত করেছে! তীর্থযাত্রীদের মতো ঢল স্থানীয় বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশীয়দের যেন মিলনমেলা। দিনরাত রোগী ও তাদের আপনজনদের পদচারণে হাসপাতালটি মুখর অথচ পরিবেশ অসাধারণ পরিচ্ছন্ন। উষ্ণ অাতিথেয়তা ও চিকিৎসাসেবায় ব্যাংকক বিশ্ববাসীর মন জয় করেছে। ব্যাংকক নগরের মাঝখানে প্রবাহিত একটি বড় খাল। দখল বা দূষণের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। অথচ দুই পাশ ুড়ে মনোরম বৃক্ষরাজি, সুদৃশ্য ভবন।
থাইল্যান্ডে ছয় মাস ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও নগরজীবনকে তার বিন্দুমাত্র উত্তপ্ত করেনি। বাংলাদেশ শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে ও প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আচরণে ও পরিচ্ছন্নতায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। ব্যাংককের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আসা কিরগিজস্তানের এক ভদ্রমহিলা ঢাকায় বিশ্বব্যাংকে তিন বছর চাকরি করার সুবাদে মন্তব্য করলেন, ‘মানুষের চেঁচামেচি ও ধুলার কারণে ঢাকা আমার ভীষণ অপছন্দ।’ আমাদের নাগরিক জীবনে কেন ভদ্রতা-নম্রতা ও পরিচ্ছন্নতার অভাব? চিন্তাচেতনা-মানসিকতা ও আচরণে কেন আমরা পরিচ্ছন্ন হতে পারছি না? সরকার একা কিছু করতে পারে না। পুলিশিং করে এবং শাস্তি দিয়েও কোনো জাতির পরিবর্তন আসে না। এ জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন, অভিরুচির পরিবর্তন এবং বিবেকবোধের জাগরণ।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিল্ক ভিটা৷
[email protected]