যেকোনো সমাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্ভবত সেই সমাজের সবচেয়ে বিবেকবান, জ্ঞানী এবং গুণী মানুষ। দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, শিক্ষকদের জন্মদানকারীদের চেয়ে বেশি সম্মানিত হওয়া উচিত, কারণ পিতা–মাতা কেবল তাদের জীবন দেয়, আর শিক্ষকেরা তাদের শেখান কীভাবে ভালো জীবন গঠন করা যায়। প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণদের যে ছয়টি কর্মের কথা উল্লেখ আছে তার মধ্যে অন্যতম দুটি হচ্ছে অধ্যয়ন ও অধ্যাপন। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের মতে, একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং সুন্দর মানসিকতার জাতি গঠন করতে সমাজের তিন ধরনের সদস্য অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারেন, তাঁরা হচ্ছেন পিতা, মাতা এবং শিক্ষক। কী প্রাচ্যে, কী পাশ্চাত্যে সব সমাজই আবহমান কাল থেকে শিক্ষকতাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। যখন এই শিক্ষকেরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তখন সেটি হয় জাতির জন্য লজ্জার এবং হতাশার।
বেশ কিছুদিন ধরে পত্রিকার পাতা খুললেই আমাদের চোখে পড়ে অসংখ্য ন্যক্কারজনক মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র। এর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অনিয়মের খবর। খবরের পাতাজুড়ে, সম্পাদকীয়তে, টেলিভিশনের আলোচনায় উঠে আসছে এই পচনের খবর। যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিশে আছে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতি। যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ডক্টর শামসুজ্জোহা উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে নিজের বুক পেতে দিয়ে ছাত্রদের রক্ষা করতে পাকিস্তানি জওয়ানদের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার পথকে সুগম করেছিল। সেই সবুজে ঘেরা পদ্মা পাড়ের এই পবিত্র অঙ্গনটি আজ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের কলঙ্কের কালিতে ম্লান। শিক্ষাঙ্গনের প্রতিটি বিবেকবান, আদর্শবান শিক্ষক লজ্জিত। শিক্ষার্থীরা বিব্রত, আশাহত।
শিক্ষকদের আদর্শহীনতা কিংবা নৈতিক অবক্ষয় নতুন কিছু নয়। এটি আমাদের পুরো সমাজের মানবিক ও সামাজিক অবক্ষয়েরই একটি খণ্ডচিত্র। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ানো যায় না। যেখানে সমাজের প্রায় সব পেশার মানুষ আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যায় দুর্নীতির সঙ্গে আপস করছে, তখন উপাচার্য তথা শিক্ষকরা তো এই সমাজেরই অংশ। আমাদের সমাজের আজকের বাস্তবতা হলো, ক্ষমতায় যাঁরাই যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। নিজেদের সুবিধার্থে একের পর এক পুরোনো নিয়মগুলো পরিবর্তন করছেন। যেই যাচ্ছেন লঙ্কায় সেই হচ্ছেন রাবণ! সমাজের সর্বত্র দুর্নীতির এই একই চিত্র—কী রাষ্ট্র, কী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সর্বত্র।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। তারপরও যখন একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে ইউজিসি তদন্ত করে ২৫টি বিষয়ে দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে মর্মে খবর আসে, তখন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে জাতির বিবেক, মানুষ গড়ার কারিগর ভাবতে খুব লজ্জা হয়। বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বভার গ্রহণের পর শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করেছেন। এমনকি আগের নিয়মে প্রথম থেকে সপ্তম পর্যন্ত মেধাক্রমের শর্তটিও তুলে দিয়েছেন। নতুন নিয়মের সুবিধাভোগী হলেন উপাচার্য মহোদয়ের মেয়ে এবং জামাতা, যাদের মধ্যে মেয়ে মেধা তালিকায় ২১তম এবং জামাতা ৬৭তম। বিষয়টি যে একটি অনিয়ম, এটি পুরো জাতির কাছে পরিষ্কার হলেও তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এই বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকারই করেননি বরং তদন্তকে একপেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে পাল্টা অভিযোগ এনেছেন ইউজিসির বিরুদ্ধে। উপাচার্যের এই স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ হলো তিনি ২০১৭ সালে উপাচার্য পদে থেকে শিক্ষকতা পেশা থেকে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করেননি। এটি করতে গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। যে ব্যক্তিগত কারণে তিনি প্রেষণে (উপাচার্য পদে) থাকাকালে শিক্ষকতা থেকে স্বেচ্ছা অবসরে গেলেন, সেই একই ব্যক্তিগত কারণ কি ওনার উপাচার্য পদে থাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি! ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে অবসরকালীন পেনশনের ৫০ শতাংশ মাসিক ভিত্তিতে নেওয়া বাধ্যতামূলক করার নতুন বিধানটি কার্যকর হওয়ার অব্যবহিত আগেই তিনি স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করলেন এবং রাষ্ট্রের এই নতুন পেনশন নীতিমালাকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হলেন। একজন উপাচার্য রাষ্ট্রের এমন একটি সম্মানজনক পদে থেকে রাষ্ট্রের একটি নিয়মকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া শোভনীয় নয়। কেননা উপাচার্য পদ কোনো ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে কমবেশি অভিযোগ উঠছে। অনেকে মনে করেন, উপাচার্য নিয়োগে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা, দলীয়করণ এবং অতিমাত্রায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এই সংকটের মূল কারণ হতে পারে।
উপাচার্যের নানা অনিয়ম–দুর্নীতির বিষয়ে যখন শিক্ষক মহল থেকে ক্রমাগত অভিযোগ উঠছে, সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হচ্ছে এবং ইউজিসি বিষয়টি আমলে নিয়ে যখন তদন্ত শুরু করল তখন প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে এই তদন্তে সহযোগিতা না করে উল্টো এই কমিশনের ক্ষমতা এবং তদন্ত প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে বিতর্কের জন্ম দিলেন। প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়, তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীতই হোন আর জনগণ কর্তৃক নির্বাচিতই হোন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার একটি ভালো সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নৈতিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে পথে হাঁটলেন না। ইউজিসি এর আগেও এই ধরনের তদন্ত করেছে এবং তার আইনগত ভিত্তি বা এখতিয়ার নিয়ে আগে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। ইউজিসি আইনের ধারা ৫–এর উপধারা ১ বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ইউজিসির এই তদন্ত করতে আইনগত কোনো বাধা নেই। এমনকি ইউজিসির সূত্রমতে, উপাচার্য নিজেই এ ধরনের উন্মুক্ত তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ফলে ইউজিসির তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা স্ববিরোধিতা এবং হঠকারিতা।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে কমবেশি অভিযোগ উঠছে। অনেকে মনে করেন, উপাচার্য নিয়োগে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা, দলীয়করণ এবং অতিমাত্রায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এই সংকটের মূল কারণ হতে পারে। ৭৩–এর স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সিনেট কর্তৃক মনোনীত তিন ব্যক্তির একটি প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য পদে নিয়োগ প্রদান করবেন। কিন্তু লক্ষণীয়, দীর্ঘদিন ধরে উপাচার্য নিয়োগের এই নিয়মটি অনুসরণ করা হয় না। কাগজে-কলমে আচার্য নিয়োগ দিলেও পুরো প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করে আচার্যের নিকট পাঠানো হয় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদানের জন্য। এভাবে সরকার তাদের মতানুসারী শিক্ষকদের এই পদে নিয়োগ দেয়, যেখানে যোগ্যতার প্রধান মাপকাঠি রাজনৈতিক আনুগত্যতা ও তদবির। ফলে প্রত্যাশী শিক্ষকেরা সরকারদলীয় রাজনৈতিক আনুগত্য প্রমাণের দৌড়ে এগিয়ে থাকার জন্য উঠেপড়ে লাগেন, রাজনীতিবিদদের দ্বারস্থ হন এবং মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করেন। এভাবে ধীরে ধীরে শিক্ষক তাঁর সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ এবং পদ-পদবি বা ক্ষমতা অর্জনের জন্য ক্ষমতার রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির মতো জাতি আশা করে উপাচার্য তথা শিক্ষকেরা সমাজের বিবেক এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন।
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ লাভের পর এসব পদের ব্যক্তিরা যাদের আনুকূল্য গ্রহণ করে ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করেন। প্রয়োজনে রাজনৈতিক নেতাদের খুশি রাখতে, সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনকে খুশি রাখতে অনিয়মের আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেন না। এভাবে ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণ বা রাজনীতিকরণ চরম আকার ধারণ করছে এবং নিয়োগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক এবং লাভজনক পদে রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং দলীয় আনুগত্য এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে। ব্যাপারটি আরও নগ্নভাবে প্রকাশ পায় যখন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘোষণা দিয়ে এই পদ ছেড়ে একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা হতে চান। কিংবা যখন উপাচার্যের সঙ্গে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাদের টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ ওঠে।
উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি অনুধাবন করেই সম্ভবত আচার্য ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি চলতি বছরের শুরুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে প্রশ্ন তুলেছেন, উপাচার্যরা নিজেরাই যদি অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী হবে। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি বলেছেন, শিক্ষক যখন তাঁর মহান আদর্শ থেকে দূরে সরে নানা প্রাপ্তির পেছনে ছোটেন, শিক্ষার্থীরা তখন নাবিকহীন নৌকার মতো দিকহারা হয়ে যায়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির মতো জাতি আশা করে উপাচার্য তথা শিক্ষকেরা সমাজের বিবেক এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। এ জন্য শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতি চিরতরে নির্মূল হওয়া আশু প্রয়োজন। কেননা, মগজে পচন জাতির জন্য অশনিসংকেত। আশা করি সরকার এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবে না।
ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক