ঘাটতি যা-ই হোক, অর্থায়ন কীভাবে হচ্ছে সেটাই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনার বিষয়। ঘাটতির মাত্রা আরেকটা কারণে বাড়বে, তা হলো রাজস্ব আয়ের মাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এটাও অর্জিত হওয়ার নয়। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা; অথচ অর্জিত হয়েছে মাত্র ৮৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষাশেষি হয়তো তা এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে। সুতরাং বাজেটে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আগামী বছরে এনবিআরের কর রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হতে হবে ২০ শতাংশ বেশি। যেখানে গত বছরের লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হয়নি, সেখানে এই বিপুল বৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার বাস্তবতা কতটুকু? এই লক্ষ্য অর্জিত হবে না এবং এর কারণেও ঘাটতির মাত্রা বাড়বে।
বিগত বছরে অর্থায়নে বৈদেশিক সাহায্য প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এসেছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে; অর্থাৎ অর্ধেকের কম। আর দুই মাসে ১ দশমিক ৭ থেকে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত তা বাড়তে পারে, এর বেশি নয়। এ বছরেই যদি এই অবস্থা, তাহলে পরের বছর এর থেকে এক বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত আশা করা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়।
ঘাটতি মেলানোর আরেকটি সূত্র হচ্ছে ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তা হলেও এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ১০ ভাগের ১ ভাগেরও কম। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই সূত্র থেকে অর্থায়ন বাস্তবায়ন করা কার্যত সম্ভব নয়। তাহলে দাঁড়াল এই: বৈদেশিক সাহায্য ও ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণ। দুুটিতেই ঘাটতি থাকলে সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হবে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের পরিমাণ প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
গতবারে দেখা যায়, সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে সত্যিকার ঋণের পরিমাণ মূল বাজেটের অনেক বেশি দেখানো হয়েছে। একইভাবে আগামী বছরেও ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণের মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। তা যদি বাড়ে, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমবে, সুদের হার বাড়বে, তাতে বিনিয়োগে টান পড়বে।
দেশীয় শিল্প বিকাশে করের ধরন কেমন হওয়া উচিত বা কর-বিন্যাসে কী করা উচিত, তা নিয়ে আমাদের দেশে কোনো গভীর বিশ্লেষণ ও গবেষণা নেই। এ নিয়ে কেউ কাজও করেন বলে জানি না। ট্যাক্স হলিডে কিংবা রপ্তানি কর বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণ নেই। যার যা মাথায় আসে আমরা তা করে ফেলি। এখন এগুলো সবই করা হয় অ্যাডহক ভিত্তিতে। দেশের সার্বিক স্বার্থ এবং মধ্যমেয়াদি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে রেখে কীভাবে কর-বিন্যাস করা দরকার, সে বিষয়ে গভীর গবেষণার ব্যাপার আছে। তার জন্য এনবিআর থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র কর মূল্যায়ন সংস্থা করতে হবে। আমি দায়িত্বে থাকার শেষ সময়ে এটা শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করে যেতে পারিনি।
নিউজপ্রিন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে শুল্কহার বাড়ানোয় দেশি কাগজশিল্পের উন্নতি হবে। অন্যদিকে কৃষি ভর্তুকি কমিয়ে দেখানো হলেও শেষ পর্যন্ত তা আরও বাড়ানো হবে বলে মনে হয়। গত বছরও সেটাই করা হয়েছে।
এ মুহূর্তে দেশীয় সম্পদ ব্যবহার করে পদ্মা সেতুতে অগ্রসর হওয়া অর্থনৈতিক বিবেচনায় মঙ্গলজনক নয়। কিছুটা অপেক্ষা করে দাতা সংস্থার সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে ছাড়প্রাপ্ত ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। বিশ্বব্যাংক তো ঋণপ্রস্তাব বাতিল করেনি, আমরাই আমাদের অনুরোধ প্রত্যাহার করেছি। এ ক্ষেত্রে আরও ধৈর্যশীল হওয়া যেত। ছয় মাস এক বছর দেরি করেও ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে সেতু নির্মাণে অগ্রসর হলে বাজেটে চাপ পড়বে না।
নির্বাচনের আগের বছরের বাজেটের মধ্যে জনতুষ্টির লক্ষ্য থাকে বলে বলা হয়। আসলে যেকোনো বাজেটেই সরকার চাইবে জনতুষ্টি অর্জন করতে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি সংখ্যাগরিষ্ঠের তুষ্টি নিশ্চিত করব, নাকি কায়েমি একটি অংশকে খুশি রাখব। এ মুহূর্তে সার্বিকভাবে বলা না গেলেও, রিয়েল এস্টেটে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই আবাসন শিল্পমালিকদের চাপে করা হয়েছে। আসলে কালোটাকা কতটুকু আসবে জানি না, তবে কালোটাকা যদি আসেও, তাহলে ফ্ল্যাট ও জমির দামে উল্লম্ফন হবে। সাধারণ মানুষের জন্য ফ্ল্যাট কেনা কঠিন হবে। বাজেট সম্পর্কে সাধারণভাবে আমি রাজস্ব আদায়, অর্থায়ন এবং এডিপি বাস্তবায়নের সক্ষমতার ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব দেখছি।
পাশাপাশি আগামী এক বছরে এবং নির্বাচন-উত্তরকালে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তার আশঙ্কা আছে, সেটা বাজেটের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে, কীভাবে সেই সমস্যা মোকাবিলা করা হবে, তার কোনো উল্লেখই নেই।
মির্জা আজিজুল ইসলাম: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থউপদেষ্টা।