ঘরে ঢোকার মুহূর্তে গিন্নি জানালেন, মনে হয় খাওয়াদাওয়া ভালোই হয়েছে। বললাম, কী করে বুঝলে? বললেন, আয়নায় চেহারাটা দেখুন। চেহারা জানাল, ফাইভ স্টার হোটেলের পেঁয়াজ, রসুন, এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনির সুবাসিত সুরুয়ার স্বাদ নিজ গণ্ডি পেরিয়ে সাদা দাড়িও গ্রহণ করেছে। রসিকতার বিরাম নেই এ নিয়ে। আট বছরের নাতি, যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেইন্টার হওয়ার সাধনায় নিয়োজিত, তিনিও যখন আঁকেন, পেইন্টিং বক্সের হলুদ রঙের সমুদয় সঞ্চয় দিয়ে তাঁর নানার দাড়ি চিহ্নিত করে থাকেন। কারণ একটিই, শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তিরা প্রায়ই এটিকে বাগে রাখতে অসক্ষম।
রবীন্দ্রনাথ যখন আশি, মঙপুতে চলছে একটি গানের জলসা। শিল্পী একজন, শ্রোতাও একজনই। শ্রোতা আমাকে বলেছেন, দু-তিনটি গান গাওয়ার পরপরই কবি যখন খানিকটা ক্লান্তির কোলে, কিশোরী মৈত্রেয়ী তাঁর জন্য প্রস্তুত রাখতেন হট ক্লিয়ার স্যুপ, কখনো চিকেন গার্লিক, কখনো ভেজিটেবল। স্যুপ গ্রহণের প্রস্তুতিপর্বে কবিকে গলায় পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাদা রুমাল, ছোট্ট শিশুটি যেন। কবি বললেন, ‘জানো মিতি, বাটির অর্ধেক খাবে এই দাড়ি।’ এখন বসে বসে দাড়ি পরিষ্কার করি, যেন চোখের সামনে ঘটনাটি ঘটছে।
শাহরুখ খানের অনুষ্ঠান প্রচারিত হলো ম্যাকাও থেকে, তিনিও অমিতাভ বচ্চনের মতো দাড়ি রেখেছেন। রমজান মাসে হয়তো রেখেছিলেন, তবে তাঁর পূর্বপরিচিত অবয়বে না দেখতে পেয়ে দর্শকেরা হতাশ। নাতি-নাতনি বলছে, হায় রে, এ কোন শাহরুখ? যাঁদের অনুকরণ করব বলে স্থির করেছি, তাঁদের সবাই ছিলেন শ্মশ্রুমণ্ডিত। তাই পরিবার থেকে শুরু করে শুভানুধ্যায়ীদের আপত্তি সত্ত্বেও দাড়ি রেখেছি।
শক্তির উত্স যদি হয় কেশ ও গুম্ফরাজি, সময়ের সেরা অভিনেতারা: ক্লার্ক গ্যাবল [পেনসিল টানা গুম্ফ], ঢেউ খেলানো চুলের উত্তমকুমার, বিশ্বজিত্ [বাল্যবন্ধু], ইউল ব্রাইনার [কেশবিহীন], টেলি সেভালাস, নাদিম [ছাত্র] দেখিয়ে গেলেন তাঁদের দাপট। রাজ্জাকের প্রথম দিকের ছায়াছবিতে তাঁর কেশসজ্জা উত্তমকুমারকে স্মরণ করিয়ে দেবে। ডক্টর জিভাগোর নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ওমর শরিফ। তাঁর মোচটি এমন মানিয়ে গিয়েছিল চরিত্রের সঙ্গে যে, এখনো ওই রকম গুম্ফ রাখতে পারলে অনেকের জীবন হতো ধন্য। বাংলার আজিম, ভারতের রাজ কাপুর, পাকিস্তানের কামাল তাঁদের গুম্ফরাজির জন্য খ্যাত, সামনে ছিল চার্লি চ্যাপলিনের গুম্ফাদর্শ।
এই প্রজন্ম স্যামসন ও ডেলাইলা ছবিটি দেখার হয়তো সুযোগ পায়নি, কাহিনির সঙ্গেও নেই পরিচয়। বাইবেলে এটি বর্ণিত। ফিলিস্তিনি নেতারা সংগ্রহ করেছিলেন সুন্দরী ডেলাইলাকে বলশালী স্যামসনের শক্তির উত্স খুঁজে বের করতে। অচিরেই ডেলাইলা আবিষ্কার করলেন, যত দিন অকর্তিত কেশরাজি খেলা করবে স্যামসনের বাহু পর্যন্ত, তাঁকে পরাভূত করার শক্তি কারোর রইবে না। ডেলাইলা ভালোবাসার অভিনয়ে শক্তিমান পুরুষসিংহকে করলেন পরাভূত এবং কোলে বসিয়ে সন্তর্পণে কেটে দিলেন তাঁর কেশরাজি, শক্তিমান হলেন শক্তিহীন। যত দিন কেশরাজি আবার স্বমহিমায় ফিরে আসে, তত দিন তিনি আর রইলেন না বীরশ্রেষ্ঠ স্যামসন।
খবরের কাগজ পড়েন যাঁরা, জানতে পেরেছেন লবকুশের ধনুর্ভঙ্গ পণের কথা। কদিন এ নিয়ে চুলাচুলি হলো। এ যুগে কেশরাজির বিন্যাসে নেই কোনো মাহাত্ম্য, সবার জানা আছে তা।
আসি বক্তব্যে। এ দেশের প্রত্যেক মানুষের চিন্তায় এখন বিরাজ করছে যা, তার প্রতিফলন না ঘটলে লেখাটি হবে মূল্যহীন। সেদিন রাতে মুঠোফোনে কল করলাম উত্তর বাংলার কয়েকটি প্রান্তজেলায় খোঁজ নিতে, বর্ষাবাদলের অবস্থা ও মানুষের মনের অবস্থা জানতে। একজন জানালেন, কেউ এখন কথা বলতে ভয় পায়। বলছে, ‘মুই জানোং না, কবরুদ্দি কবার পায়।’ অর্থাত্, আমি জানি না, কবরুদ্দি বলতে পারবে। এভাবে পুরো বাজারের প্রত্যেক মানুষ একে-ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে। বলা তো যায় না, কে কোথায় বিপদে পড়ে। যেখানেই ফোন করি, সাবধানে কথা বলছেন সবাই। দেয়ালেরও নাকি কান আছে, মুঠোফোনের তো আছেই। শেষ পর্যন্ত পেলাম একজন সাবেক সাংসদকে। তিনি বললেন, ‘আপনি তো কবিমানুষ।’ এর উত্তর দিই শহীদ কাদরির কবিতার ভাষায়: ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই।’
অধ্যাপক ইউনূস জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করতে মধ্যস্থতায় রাজি তিনি। ইতিপূর্বে স্বনামধন্য আইনজীবী রফিক-উল হকের প্রস্তাবটি শূন্য মাঠে শূন্য গোল করেছে। আমার একজন অনুরাগী খানিক আগে বলেছেন, ‘দুই পক্ষেরই “ভালো বই”তে আছেন বিধায় মধ্যস্থতা করতে দোষ কী। আপনি কোনো দিন যাননি কারও কাছে কোনো দরখাস্ত নিয়ে, দল বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেননি কটু কথা। দুজনের প্রতি রয়েছে আপনার শ্রদ্ধা অটুট।’
এবার তাহলে জানাই। কথা মানতে প্রস্তুত হলে মধ্যস্থতার জন্য দেশের সবাই রাজি, আমিও। দুজনই যখন মুখোমুখি, নজরুলের গান শোনাতে পারব, রবীন্দ্রনাথেরও। বাবার গাওয়া গানটি প্রস্তুত রেখেছি: ‘ও তুই যারে আঘাত হানলি রে মনে, সে জন কি তোর পর’? সেই সঙ্গে আরও ৫০টি। দোতরা ঘাড়ে সোলেমান মিয়া প্রস্তুত, সঙ্গে বাজাবে বলে। সংগীত মিলনের কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে। জীবনভর এ ভালোবাসার গান গেয়ে গেলাম।
প্রার্থী হওয়ার পেছনের কারণ; ‘দুখের সাহারা পার হয়ে, আমি চলেছি কাবার পানে।’ যে ক’গাছি চুল সম্বল, ততক্ষণে বিসর্জন দিয়ে এসেছি, শ্মশ্রুরাশি নয়। ৩০ অক্টোবরের পর তাঁর করুণায় বিধৌত হয়ে যেকোনো মঙ্গলময় কাজের জন্য প্রস্তুত। মঙ্গলের দিকে হব ধাবিত। এ সুযোগ জীবনে আসবে না। বলতে দোষ কী।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
[email protected]