আজ ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস। বিশ্বব্যাপী বনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ২০১২ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ বছর বন দিবসের প্রতিপাদ্য হলো—‘বন সংরক্ষণের অঙ্গীকার, টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার।’ প্রতিপাদ্যটি বনজ প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই উৎপাদন ও যথাযথ ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বনজ সম্পদের ভারসাম্যপূর্ণ উৎপাদন ও ব্যবহার দারিদ্র্য বিমোচন, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও সবুজ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করা ও কাঠ, খাদ্য, পানি, জ্বালানি, পশুখাদ্য, ওষুধ, বন্যপ্রাণীর বাসস্থান, জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু প্রশমন, ইকোট্যুরিজম এবং সবুজ পেশার জন্য টেকসই বনজ সম্পদ উৎপাদন একটি পূর্বশর্ত। জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ও অধিক ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের ভিত্তি হুমকির মুখে রয়েছে। এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস ও বনভূমি উজাড় হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী জীবন ও জীবিকার জন্য হুমকি। বনজ সম্পদের টেকসই ব্যবহার বাড়াতে ইতিমধ্যে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় মিশ্র প্রজাতির বনায়ন, কৃষি-বনায়ন, সহব্যবস্থাপনা, মা বৃক্ষ সংরক্ষণ, টিস্যু কালচার ও দক্ষ পেশাদার জনশক্তি তৈরি ইত্যাদি।
আমরা কি যৌক্তিকভাবে বনজ সম্পদ ব্যবহার করছি
বাংলাদেশে ২ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে, যার মধ্যে বন অধিদপ্তরের অধীনে আছে ১ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন হেক্টর, যা মোট বনভূমির ৭৩ শতাংশ। অবশিষ্ট শূন্য দশমিক ৬৯ মিলিয়ন হেক্টর (২৭%) পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অধীনে রয়েছে। খাদ্য, কাঠ, জ্বালানি, ওষুধসহ অনেক বনজ সেবার ওপর স্থানীয় জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল। সরকারের অধীনস্থ বন থেকে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যার কারণে বাংলাদেশে কাঠের চাহিদার অধিকাংশই পূরণ হয় বসতবাড়ির আশপাশের বন, অংশগ্রহণমূলক সামাজিক বনায়ন ও আমদানি করা কাঠ থেকে। কাঠের পণ্য ছাড়া অ-কাষ্ঠ বনজ পণ্য (মধু, বেত, বাঁশ ইত্যাদি) বনের মধ্যে এবং তার আশপাশে বসবাসকারী বননির্ভর মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশ ফরেস্ট ইনভেনটরি ২০১৯–এর তথ্যমতে, বনাঞ্চলের আশপাশে বসবাসকারী ৬৫ শতাংশ পরিবারই এসব অ-কাষ্ঠ বনজসামগ্রী সংগ্রহ করে।
বননির্ভর ও বন–সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হচ্ছে অ-কাষ্ঠ বনজ দ্রব্য। যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি কাঠ, ফল, ঔষধি গাছ, লতাপাতা, পশুখাদ্য, মধু, খড়, মাছ, কাঁকড়া, শাকসবজি, ভোজ্যপাতা ও কাণ্ড। যখন কৃষিতে ভালো ফসল হয় না, বা যখন পরিবারগুলো আর্থিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, তখন এসব বনজ পণ্য তাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করে। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের জন্য ও হতদরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, যাদের নিজেদের বসতভিটা বা কৃষিজমি নেই, তারা দৈনন্দিন পুষ্টির জন্য, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন ও ক্যালরির জন্য বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল।
ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বনজ পণ্যের বৈচিত্র্যতার কারণে মানুষের মাঝে বনের কাঠ ও অ-কাষ্ঠ পণ্যের ব্যবহার স্পষ্টতই বাড়ছে। বনজ পণ্যের ব্যবহার বাড়ার কারণে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দ্রুতই বেড়ে যাচ্ছে। বনজ পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যকার যে পার্থক্য, তা বনজ পণ্যের যথাযথ ও যুক্তিসংগত ব্যবহারের মাধ্যমে কমানো সম্ভব। কাঠের পণ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, কাঠকেন্দ্রিক শিল্পে কাঠের অপচয় রোধ, নৈতিক ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব লেবেলিং বনজ সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
আমাদের করণীয় কী
বনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের জন্য জাতীয় আইন, নীতি, কৌশল, আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং কনভেনশন রয়েছে। বনের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) অধীনে বাংলাদেশ সরকার বন ব্যবস্থাপনা উন্নীতকরণের ওপর জোর দিয়েছে। বনের ওপর চাপ কমাতে বননির্ভর মানুষের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা এবং দখলকৃত বন পুনরুদ্ধারে সরকার আগ্রাধিকার দিচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক বন ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন, বন্যপ্রাণী ও বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে বন টহল দলের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার সচেষ্ট।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবিত নীতি ও ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি কাঠের বিকল্প হিসেবে অন্য জ্বালানি শক্তির টেকসই সরবরাহ, জ্বালানি কাঠের জন্য পতিত জমিতে বনায়ন করা, বনের মাধ্যমে কার্বন মজুত বাড়ানো, উন্নত ভূমি ব্যবহার নীতি বাস্তবায়ন, বন উজাড় এবং বনের অবক্ষয় মোকাবিলায় অংশীজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি যোগাযোগ প্রটোকল তৈরি করা। অধিকন্তু, বনবিদ্যার একাডেমিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি সহযোগিতা বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রযুক্তির বিকাশ এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে।
এ ছাড়া বেসরকারি খাতের অনেক কোম্পানি বন ধ্বংস বন্ধ করতে তাদের সাপ্লাই চেইন থেকে অবৈধ কাঠের পণ্য বাদ দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। উল্লেখ্য, অল্প সময়ের মধ্যে বনের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার অর্জন করা সম্ভব নয়। নীতিনির্ধারক ও সরকারের সহযোগিতায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা অন্তত ২০৩০ সালের মধ্যে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছানোর আশা করতে পারি, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের বনগুলো দীর্ঘস্থায়ী ও আরও ভালো অবস্থায় থাকে।
মো. সামছ উদ্দিন একাডেমিক এবং রিসার্চ কো-অডিনেশন স্পেশালিস্ট, কম্পাস প্রোগ্রাম, ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস বাংলাদেশ
সাহাদত হোসাইন শাকিল পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন স্পেশালিস্ট, ইউএসএআইডি, বাংলাদেশ
সহদেব চন্দ্র মজুমদার জিআইএস অ্যানালিস্ট, কম্পাস প্রোগ্রাম, ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস, বাংলাদেশ