সকালবেলায় শিল্পী গেয়ে গেলেন: ‘তোমার আসন পাতব কোথায় হে অতিথি/ ছেয়ে গেছে শুকনো পাতায় কানন বীথি’। গান শেষ হয়েছে, স্পর্শটুকু বাতাসে। আরেকটিবার শোনার জন্য মনের হাহাকার। ওটি তো চিরদিনের জন্য ভেসে গেল।
পাঁচতলা ব্যালকনির বাগানে টগবগে যায় যায় শীতের পুষ্পরাশি। সর্বশেষে ফোটা হলুদ-সাদার ডালিয়া ভাবছে কী হবে ফুটে, ব্যস্ত পৃথিবীর কেউ তো আর তাকিয়ে নেই তার দিকে। ফুলের অভিমানটুকু স্পর্শ করলাম। অনেকক্ষণ ধরে গাছটির পরিচর্যা করলাম কাল। আজ সকালে অবাক হয়ে দেখি, দল মেলে আমার দিকে তাকিয়ে, যেন বলছে, গতকাল আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে, চারদিকটা পরিষ্কার করেছিলে, পানি দিয়েছিলে, তাই আজ আমি শুধু তোমার জন্য ফুটেছি। শত ফুল ফুটিয়ে বসন্ত চলে যায়, তার হাওয়া দিয়ে যায় ক্ষণিক মন কেমন করা হাওয়া। প্রতিটি ফুলই তা-ই। লিখেছিলাম, সাসকেহেনা ভ্যালি, লুইসবার্গে:
অনায়াসেই হলুদ ফুলের সবটুকু ব্যথা সবটুকু রং গেঁথে নিল আমার হূদয়ে
তোমার গান যদি কেউ না শোনে বনলতা
আমি সারা দিন সারাক্ষণ সারা দিনক্ষণ চিরদিন রইব তোমার পাশে
যখন আমি চলে যাব এই উপত্যকা থেকে
তখনো জানবে তুমি, আমি আছি তোমার পাশেই
অচঞ্চল, অপলক আঁখি নিয়ে। [‘যুগলবন্দী: সেতারে নয় কবিতায়’, অক্টোবর ১৯৯৭]
আরও ভাবি, মনীষীদের ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারি না বলে প্রায়ই পড়ে থাকি একা। ফুল ও বাতাসের মতো তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া সম্ভব, সৃষ্ট জগৎ বইয়ের মাধ্যমে। মনে পড়ে, বহু বছর আগে নর্থ ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে পৃথিবীর কিছু শ্রেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে মনের আদান-প্রদান।
স্যার যদুনাথ সরকারের জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডের ফসল মোগল সাম্রাজ্যের পতনবিষয়ক বিরাট গ্রন্থটি আমাকে নিয়ে আসে তাঁর কাছে। ওঁর অন্যতম বিখ্যাত আবিষ্কার প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত মোগলদের বিজয়ের বঙ্গ বিজয়ের কাহিনি: বাহারিস্তান-এ-গায়িবীর হস্তলিপি। স্যার যদুনাথ ছিলেন প্রকৃত অর্থে ইতিহাসের মনীষী। তাঁর বাইরের ঘরটি পড়ার ঘর হিসেবে অন্যকে ব্যবহার করতে দিতেন। নানা পুঁথির মাইক্রোফিল্ম কপি আনিয়ে তার ফটোকপি করে কোনো মৌলভিকে দিয়ে সুন্দর নাস্তালিক অক্ষরে তার অনুলিপি করিয়েছিলেন। যদি হতাম তাঁর ছাত্র, তাঁরই সান্নিধ্যে বসে তাঁর লেখা বইগুলো পড়ার সুযোগ গ্রহণ করতাম। মাঝেমধ্যে এসে শুধাতেন: তোমাদের এক কাপ চা দিতে পারি, অথবা ফ্যানটা বন্ধ করে দেব?
স্যার যদুনাথের প্রতি আকৃষ্ট তাঁর বই পড়ে। তখনো পাইনি তপন রায় চৌধুরীর বাঙালনামা। যখন যদুনাথের বয়স ২০, এমএ পাস করার পর স্থির করেন, মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন। প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারশিপের জন্য বরাদ্দ করা ১০ হাজার টাকায় গবেষণার জন্য দরকারি মূল পুস্তক সংগ্রহ শুরু করেন। সে সংগ্রহে ছিল অনেক কিছুই। যদি তাঁর সংগ্রহশালায় গিয়ে ঢুকে পড়তে পারতাম, তাঁর রচিত পাঁচ খণ্ড আওরঙ্গজেবের ইতিহাসই পেতাম না, পেতাম সেই সময়ের সংগৃহীত ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যবিষয়ক ও গবেষণাভিত্তিক নানা গ্রন্থ। যতই পড়ি তাঁর কথা, অবাক হই। ৪০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত বয়সে তিনি লিখেছেন আওরঙ্গজেবের ইতিহাস, ৬০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস।
অধ্যয়নের জন্য নর্থ ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির চেয়ে সুন্দর লাইব্রেরি আর খুঁজে পাইনি। সামনে সমুদ্র, যেখান থেকে ছুটে আসছে দুরন্ত হাওয়া। আর সেখানেই খুদে ঐতিহাসিক পেলাম, স্যার যদুনাথের চরণ স্পর্শ। সুখাদ্যের অন্বেষণে বাজার থেকে তিনি নিজেই কিনে আনতেন খাঁটি দই, কলা ও ছোট মাছের মুড়ো, যেমনটি আমার বাবা। স্যার যদুনাথ ও আমার বাবা একই কথা বলতেন: যে বাজারে যাবে না, ভালো খাবে কোত্থেকে? ৯০ বছর বয়স না হওয়া অবধি স্যার যদুনাথ রোজ আট ঘণ্টা কাজ করতেন, আট ঘণ্টা ঘুমাতেন, সকাল-বিকেল ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা হাঁটতেন। এসব কাজের উদ্দেশ্য: শরীরটাকে বাগে রাখতে হবে, যাতে একটি দিনও ক্ষয় না হয়। দার্জিলিংয়ে বাড়ি করেছিলেন, যাতে গ্রীষ্মের দিনগুলো কাটে শীতের পরশে। ফল অব দ্য মোগল এম্পায়ার না পড়লে ইতিহাসের নানা কাহিনি থাকবে অজানা।
তপন রায় চৌধুরীর বাঙালনামা পাঠ করি আইইউবির প্রয়াত ভাইস চ্যান্সেলর বজলুল মমিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে। এটি এমন একটি গ্রন্থ, যার প্রতি ছত্র পাঠককে করে উজ্জীবিত, দেয় পাঠ করার প্রেরণা। বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সঙ্গে, বিশেষ করে তাঁর বাবা অমিয় কুমার রায় চৌধুরী, কুমার প্রসাদ, অম্লান দত্ত, নীহার রঞ্জন রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অমলেশ ত্রিপাঠী, বিষ্ণু দে, নন্দলাল বসু, রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাধারানী দেবী, অমর্ত্য সেন ও তাঁর স্ত্রী হাসি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দিয়ে হাঁটার সময় রোজই দেখা কয়েকজন নোবেল লরিয়েটের সঙ্গে। ওঁদের অজান্তে টুপিটি খুলে সম্মান জানাতাম। তপন রায় চৌধুরীর বইটি ঠিক সেই সম্মান নিয়ে পাঠ করেছি।
ফুলের দিকে তাকাতে হয় যেমন, গানের বাণী যেমন থাকে হূদয়ে, তেমনি মনীষীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়। ফুল ফুটিয়ে চলে গেছেন ওঁরা, লেখা বইগুলো সেই ফুলের সাজি। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি, কালো অক্ষরের মায়ায় বন্দী হরফগুলো তার সুবাতাস ছড়িয়ে যায়। শুধু গ্রহণের অপেক্ষা।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
[email protected]