আমাদের ছেলেবেলার মফস্বল শহরে পয়লা বৈশাখ আর হালখাতা ছিল অনেকটা যমজ ভাইবোনের মতো। হাত ধরাধরি করে হাজির হতো দুজনে বছরের প্রথম দিনটিতে। বর্ষবরণের আনন্দ-মাতনে সেই ছোট শহর আর কতটুকুই বা মেতে উঠত। তবে বাজারের প্রায় সব দোকানেই বাংলা বছরের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ হতো বেশ ঘটা করেই। এই দিন দোকানে অতিথি-অভ্যাগতদের মণ্ডা-মিঠাই দিয়ে আদর-আপ্যায়ন করা হতো। আর সেটিই ছিল আমাদের ছেলেবেলার পয়লা বৈশাখের বাড়তি আকর্ষণ। অভিভাবকদের হাত ধরে আমরাও মাঝেমধ্যে সেই নিমন্ত্রণে হাজির হয়েছি। বড়দের মতো আমাদের প্লেটেও দেওয়া হয়েছে রসে ডুবুডুবু ধবধবে সাদা বড় রাজভোগ, ভেতরে ছোট ক্ষীরের পুঁটলিতে পোরা সুগন্ধি একটি এলাচদানা।
সঙ্গে কালিজিরা ছিটানো হালকা গেরুয়া রঙের একখানা নিমকি। মচমচে ভাজা। পাশে পিঠে গন্ধ কর্পূর মেশানো ঠান্ডা এক গ্লাস পানি। রাজভোগের মিষ্টতার বিলাসী আবেশের সঙ্গে নোনতা নিমকির নিরপেক্ষ স্বাদ এই দুই বিপরীত রসের স্রোতে রসনার তৃপ্তি হতে সময় লাগত না। কবি কি আর সাধে বলেছেন: ‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়।’
সেই কম বয়সে এত গূঢ় তত্ত্ব অবশ্য আমাদের নজরে পড়েনি, পড়ার কথাও নয়। নজরে পড়েছিল অনেক পরে। হালখাতার জাগতিক অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধিও তখন ছিল না।
পরে একটু বড় হয়ে জেনেছিলাম, হালখাতা নতুন বাংলা বছরের হিসাব টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের অর্থাৎ দেশীয় ধরনের যাঁরা ব্যবসার হিসাব রাখেন, তাঁদের নতুন খাতা খোলায় এক আনুষ্ঠানিক উৎসব। পয়লা বৈশাখের এই অনুষ্ঠানটি এখন বেশ কিছুটা কমে গেছে। তবু হালখাতা এখনো যথারীতি খোলা হয়। এতে ব্যবসায়ীরা তাঁদের লেনদেন, বাকি বকেয়া, সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখেন। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে যাঁরা ব্যবসায়ীদের নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থী, তাঁদের চিঠি দিয়ে বা লোক মারফত আমন্ত্রণ জানিয়ে জলযোগে আপ্যায়ন করা হয়। এই দিনটিতে কেনাবেচার চেয়ে সামাজিকতা ও সৌজন্য বিনিময় হয় বেশি। তবে মনন সৌজন্যমূলক হলেও এ সুযোগে অনেকে তাদের বকেয়াও শোধ করে দেন।
হালখাতার অনুষ্ঠানটি অবশ্যই পয়লা বৈশাখে প্রতিপালিত হতে হবে। সেদিন যে নতুন খাতার সূচনা হয়, তা অন্য দিনে চলে না। ব্যাপারটি সাংবাৎসরিক হিসাব রাখার বিষয় বলে তার ব্যবস্থা বাধ্য হয়েই নির্দিষ্ট দিনেই করতে হয়। হালখাতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো সম্বন্ধ নেই, যদিও হালখাতার মাথায় একটা স্বস্তিবচন লেখা থাকে। মুসলিম ব্যবসায়ী হলে তাঁর হালখাতায় ‘এলাহি ভরসা’ অথবা হিন্দু ব্যবসায়ী হলে ‘গণেশায় নমঃ’ লেখা থাকতে পারে। ড. এনামুল হক লিখেছেন, ‘এতে বাংলা নববর্ষের এই অনুষ্ঠানটিকে ধর্মপ্রভাবান্বিত বলা চলে না। এটা ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি মাত্র, হালখাতার মূল লক্ষ্য হিসাব-নিকাশের অঙ্গ নয়। এই স্বস্তিবচন লিখলেও হালখাতা হিসেবের খাতায় থেকে যায়।’
হালখাতা শব্দটি বাংলা ভাষার অতিথি, আরবি-ফারসি জাত। জমিদারি আমলে ‘হালখাতা’ বৈভবের চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। সেই রমরমা অনেক দিন গত। তবু হালখাতা টিকে আছে, ডিজিটাল ঝাপটা সামলে হয়তো টিকেও থাকবে আরও কিছুদিন।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। তখন কোনো কোনো বছর শহর-গ্রামে মানুষ আর প্রাণীর জন্য ভীষণ জলকষ্ট দেখা দিত। সেই ভয়াবহ জলকষ্টের করুণ মর্মস্পর্শী ছবি রয়েছে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে। গফুরের বলদ মহেশ তেষ্টা সইতে না পেরে আমিনার ঘট ভেঙে পানি খাওয়ার অপরাধে প্রাণ দিয়েছিল। এই নিদারুণ কষ্টের ছবি আজ অনেকখানি বদলে গেছে। এখন আর পানির অভাবে অসহায় গফুরের ‘মহেশ’ বেঘোরে প্রাণ হারায় না। শ্যালো আর ডিপ মেশিনে দেশ সয়লাব এখন। তবে গফুরের মহেশের ‘চরে খাবার এতটুকু জমি’ এখনো কেউ রাখেনি। মহেশের চরে খাবার ঘাস কোথায়? সব জমিই তো হয় খাস, নয় অন্যের দখলে। পতিত জমি কোথায়?
এখন, পানির অভাব না থাকলেও জলকষ্ট হাজির হয়েছে এক নতুন বেশে, বিশেষ করে দেশের উপকূলের অনেক জেলাতে। চৈত্র-বৈশাখ এলেই বৃহত্তর খুলনার অনেক জেলায় খাওয়ার পানির টানাটানি পড়ে। এলাকায় বেশ কিছু নলকূপে এ সময়টায় লোনাপানি ওঠে। ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে পুকুরগুলোতে লোনাপানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে পানি। পুকুরের শোধন করা পানি লিটার হিসাবে বিক্রি হয়। তাই কিনে খেতে হয় মানুষের। এমনকি কিছু কিছু গভীর ও অগভীর নলকূপের স্তরেও লোনাপানি ঢুকে পড়ে। ভরসা তখন পুকুরের পানি। এসব অঞ্চলে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে উদ্যোগ ও বিনিয়োগ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরেও এলাকাভেদে পানিবৈষম্য রয়েছে। বৈশাখ শুরু হলেই এই অসুবিধা বাড়ে। বাড়ে মানুষের কষ্ট।
নান্দী আর নিন্দা—দুই-ই জুটেছে বৈশাখের কপালে। তবু সবকিছু উপেক্ষা করে প্রতিবছরই যেন নানা উপহারের ডালি সাজিয়ে আমাদের আপ্লুত করে। সেই ডালিতে কী নেই? নতুন কাটা ধানের পিঠার সুবাস, চড়কের মেলার মুঠো মুঠো আনন্দ। গাছে গাছে সবুজ নতুন পাতা, বাগানবিলাসের রঙের উল্লাস, বাসা থেকে পাখির ছানার প্রথম ওড়ার শিহরণ, শেষ বিকেলের বৈশাখে কোনো নিঃসঙ্গ কোকিলের ডাক বাতাসের সঙ্গে ভেসে বেড়ায়। এত বৈচিত্র্য, এত দহন আর তৃপ্তি অন্য কোনো ঋতুর ভান্ডারে খুঁজে পাওয়া দায়।
আর গরমের পারদ একটু চড়লেই কালবৈশাখী এসে শীতল করে উষ্ণ ভূমি, তাপিত কাতর জনপদ। সন্দেহ নেই কালবৈশাখী ভাঙচুর, লন্ডভন্ড করে প্রচুর। তবে লন্ডভন্ড, তাণ্ডব শুধু যে কালবৈশাখী করে, তা তো নয়।
পয়লা বৈশাখ—নববর্ষের উৎসব, যা আমাদের সমাজজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্মল, ভেদবুদ্ধিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক উৎসব। জীবনের উচ্ছলতায়মাখা এই উৎসবের আনন্দধারায় প্রবেশদ্বার জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের জন্য উন্মুক্ত। মানবিক এবং উদারনৈতিক মূল্যবোধে সজ্ঞাত এক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক সমাজজীবনে আমাদের উত্তরণ হতে পারে এই মহান উৎসবের হাত ধরে।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত, লেখক।
[email protected]