প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মানুষ ভরসা পায়নি

জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সংসদের বাজেট আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া যে বক্তব্য রেখেছেন, তা চলমান রাজনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। তাঁদের ভাষণের ওপর এখানে দুজন বিশ্লেষকের মন্তব্য প্রকাশ করা হলো:
২৯ জুন বিরোধীদলীয় নেতা ভাষণ দেওয়ার পর সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ভাষণ দেন। স্বাভাবিকভাবেই সংসদ নেতার সুবিধা এই ছিল যে তিনি তাঁর বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতার কিছু কিছু বক্তব্য খণ্ডন করার সুযোগ পেয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণটি ছিল দীর্ঘ ও লিখিত। দুজনের বক্তব্য পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেটা হলো বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণটি ছিল বেশ মার্জিত। সেই তুলনায় প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা যে তাৎক্ষণিক বক্তব্য দেন, সেই বক্তব্যে বেশ কিছু বক্রোক্তি স্থান পেয়েছে। তাঁর বক্তব্যটি ছিল মূলত রাজনৈতিক। তিনি বলতে চেয়েছেন পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন হবে। দুর্নীতির ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি বলতে চেয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি হয়নি। তিনি আরও বলেছেন, শেয়ারবাজার, হল-মার্ক ও ডেসটিনির অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে বিএনপি জড়িত।
প্রথমেই আমরা আলোচনা করতে পারি, আগামী সংসদ নির্বাচন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি। তিনি তাঁর অবস্থানে অনড় রয়েছেন। অন্যদিকে, বিরোধীদলীয় নেতাও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে অনড় রয়েছেন। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী এই অবস্থানের ফলে দেশের সাধারণ নাগরিকেরা স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কা করছে যে, দেশের জন্য আগামী দিনগুলো খুব সুখকর হবে না। বরং সংঘাত-সংঘর্ষ এবং রক্তপাত দেশবাসীর শান্তি কেড়ে নেবে। দেশবাসী আর অশান্তি চায় না। তারা চায়, নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়টির একটি সন্তোষজনক সমাধান, যা শেষ বিচারে দেশের জনগণ এবং বিবদমান সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই প্রশ্নে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা বলতে গেলে ফিকে হয়ে গেছে। এতে দেশবাসীর মধ্যে চরম হতাশাবোধের জন্ম হয়েছে। আনন্দের কথা এই যে বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর ভাষণ শেষ করতে গিয়ে উপসংহারে সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছেন। কিন্তু সংলাপ প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে নীরবতা দেশবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। 

আমরা আশা করেছিলাম, বিরোধীদলীয় নেতার সংলাপ-সংক্রান্ত বক্তব্যের পর সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণ দিতে গিয়ে সংলাপ সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করবেন। সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। এ রকম একটা জটিল বিষয় নিয়ে ফয়সালায় পৌঁছাতে হলে এক বা দুটি বৈঠকেই সমস্যাটির নিষ্পত্তি হবে না। এর জন্য বেশ কিছুসংখ্যক বৈঠকের প্রয়োজন আছে। কাজেই, সময় থাকতে বৈঠকের মাধ্যমে সংলাপ-প্রক্রিয়া শুরু করলে সমস্যার সমাধান সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও আশাবাদী হতে পারতাম। প্রধানমন্ত্রী এখনো বলে চলেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রের মতোই আগামী নির্বাচন এ দেশে অনুষ্ঠিত হবে। তাঁকে একটি বিনীত প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্নটি হলো, যদি ঘটনাচক্রে এই মুহূর্তে বিএনপি ক্ষমতায় থাকত এবং তারা যদি বিরোধী দলে থাকত, এবং বিএনপি যদি বলত, পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের মতোই আগামী সংসদ নির্বাচন হবে, তাহলে কি সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করত? আওয়ামী লীগ যে অংশগ্রহণ করত না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছিল। ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল তারা সে সময়। অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমেই তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা হয়েছিল।
বিএনপির পক্ষে সে সময় সংসদে সংবিধান সংশোধনীর মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে দলটিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর একতরফা নির্বাচন করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করতে হয়েছে। তবে, সে সময় বিএনপি উপলব্ধি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাস করা তাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই জাতি মহাসংকট থেকে রক্ষা পায়। এবার, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলোপ করা হয়। কিন্তু প্রথম আলোর জরিপ অনুসারেই দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি হবে বলে জুজুর ভয় দেখানো হচ্ছে। এক-এগারোতে যা ঘটেছিল, সেটা ছিল সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। কাজেই এক-এগারোর জুজুর ভয় দেখানোর মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। দেশের সব মানুষ আন্তরিকভাবে সমস্যাটির একটি সন্তোষজনক সমাধান চায়।
সংসদ নেতা দেশে মারাত্মক ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির যেসব ঘটনা ঘটেছে, যেমন হল-মার্ক ও ডেসটিনি সেগুলোর বিষয়ে বলতে চেয়েছেন, এসব ঘটনার কুশীলবেরা বিএনপির সঙ্গে জড়িত। তাহলে, এঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের অসুবিধা কোথায়? তিনি আরও বলেছেন, ‘বিরোধীদলীয় নেতার প্রিয় ফালু ও বাদলকে ধরলেই শেয়ারবাজারের টাকা কোথায় গেল তা জানা যাবে।’ তাহলে প্রশ্ন ওঠে শুধু ফালু বা বাদল নয়, অন্য সব কুশীলবেরা যেমন ‘দরবেশ’ বলে পরিচিত এক ব্যক্তি—তাঁদের ব্যাপারে কেন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না? আসলে রাজনীতিতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর একটি সংস্কৃতি বিদ্যমান। এ ছাড়া রয়েছে পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতি। এই দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়ে একটু আত্মসন্দর্শনে লিপ্ত হলে রাজনীতির অনেক সমস্যা সহজ হয়ে যায়।
আমরা চাইব, যাঁর অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, তিনি যেন একটু বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিটি সমস্যাকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেন। এ ছাড়া সংসদের অধিবেশনে কটুকাটব্য কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংসদে বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনার সুযোগ অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা যেন তিক্ততায় পর্যবসিত না হয়। সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজর রাখতে হবে। সংসদের ভাষণ সংসদ টিভির মাধ্যমে দেশবাসী দেখে ও শোনে। কাজেই দেশবাসী নিজ বিচারে স্থির করতে পারেন, কার বক্তব্য শোভন ও যুক্তিসংগত। এবং কার বক্তব্য অশোভন এবং যুক্তিরহিত। শোভন আচরণের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র সুসংহত হতে পারে।
ড. মাহবুবউল্লাহ: অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।