প্রতিক্রিয়া: বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা কেন সাধারণ ক্যাডারে?

বিশেষায়িত ক্যাডারের সদস্যদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত
প্রথম আলো

গত ৫ জুলাই প্রথম আলোতে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের লেখা ‘সাধারণ ক্যাডারে এত বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী কেন’ শিরোনামের লেখা পড়লাম। লেখক সাধারণ ক্যাডারে বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীদের নিয়োগের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বিসিএস পরীক্ষার নিয়ম ও সিলেবাস পরিবর্তনের সুপারিশের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সবার সমান সুযোগ চেয়েছেন। ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার মধ্যে মাত্র ১০০ নম্বর রয়েছে, এমন বিষয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। এসব বিষয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাস থেকে প্রশ্ন করা হয়। আর এটুকু গণিত বা বিজ্ঞান প্রযুক্তির জ্ঞান না থাকলে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন?

লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ সাধারণ ক্যাডারে চলে এলে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষি শাস্ত্র বিশেষায়িত শিক্ষা হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পদগুলো এসব ক্যাডারের সদস্য দ্বারা পূরণ করা উচিত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডার, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যদি বিচার বিভাগের সদস্য দ্বারা পূরণ করা যায়, তাহলে প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষি ক্যাডারের সদস্য দ্বারা ওই সব মন্ত্রণালয়ের পদগুলো পূরণ করা যুক্তিসংগত নয় কি? মন্ত্রণালয়ের পদগুলো স্ব স্ব ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত থাকলে সার্ভিস পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর কার্যকর হতো; প্রকৌশলী ও চিকিৎসকেরা নিজেদের ভালোবাসার পেশা ছেড়ে অন্য সার্ভিসে চলে যেতেন না।

প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ তাঁদের নিজস্ব বিশেষায়িত ক্ষেত্র ছেড়ে কেন পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ ক্যাডারে চাকরি করতে চান? বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য আছে। প্রশাসন ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকা সত্ত্বেও পদের তিন-চার গুণ বেশি পদোন্নতির ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে বিশেষায়িত ক্যাডারের সদস্যদের পদোন্নতির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। উল্লেখ্য, ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের প্রশাসন সার্ভিসে প্রায় ৫ হাজার জন কর্মরত। অথচ আমাদের ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রশাসন ক্যাডারে তার থেকে প্রায় দেড় গুণ বেশি জনবল কর্মরত।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য যেখানে স্পেশাল গ্রেড, অজস্র গ্রেড-১ ও গ্রেড-২-এর পদ রয়েছে, সেখানে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের অল্প কয়েকজন চাকরিজীবনের শেষ দিকে গ্রেড-২ বা গ্রেড-৩-এর পদে যেতে পারেন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ব্যক্তিরই গ্রেড-৪ বা তার নিচ থেকে চাকরিজীবন শেষ করতে হয়। আগে পদোন্নতি না পেলেও আর্থিক সুবিধা প্রদানের জন্য সিলেকশন গ্রেডের ব্যবস্থা ছিল। সর্বশেষ বেতন স্কেলে সে ব্যবস্থাও রহিত করা হয়েছে। বিভিন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, করপোরেশনগুলোর পরিচালক ও তাঁর ওপরের পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা হয়। ফলে এসব দপ্তরের নিজস্ব কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। উপসচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সদস্যরা পাচ্ছেন ব্যক্তিগত ৩০ লাখ টাকার গাড়ি কেনার ঋণসুবিধা, রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসিক অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু অন্যরা এই সুবিধা পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে পেশাজীবীদের যোগ্যতা ও দেশের উন্নয়নে তাঁদের অবদানের ভিত্তিতে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। জেলা/উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভাসহ অন্যান্য সভায় কলেজের অধ্যক্ষ, কৃষি কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী ও অন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য সম্মানজনকভাবে আসন সংরক্ষণ করা হয় না। সমন্বয় সভায় সমস্যা সমাধানের সঠিক দিকনির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত দিতে খুব কমই দেখা যায়। বরং যাঁরা মাঠেঘাটে কাজ করেন, তাঁদের কাজের ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি বড় করে দেখিয়ে তাঁদের মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এ দেশে কোনো কোনো সার্ভিস ক্যাডারের সদস্যদের জনপ্রশাসন পদক, রাষ্ট্রপতি পদক প্রভৃতি প্রদানের মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বিশেষায়িত ক্যাডারের সদস্যদের মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন চিকিৎসক এমবিবিএস, এফসিপিএস/এমডি পাস করে ২০-২৫ বছর উপজেলা পর্যায়ে চাকরি করেও সপ্তম গ্রেডের ওপরে উঠতে পারেন না বা ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পান না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষজ্ঞদের প্রশাসনের শীর্ষপদে পদায়নের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক ও জনবান্ধব প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সে ব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটে। তারপর থেকে অত্যন্ত সুকৌশলে আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য সৃষ্টি করা চলেছে। অপেক্ষাকৃত মেধাবী প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের অবমূল্যায়িত করা হয়েছে। দেশ আজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশের জনগণ বড় বড় সেতু পার হয়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যাচ্ছেন; অবকাঠামোগত উন্নয়ন‚ শিশুমৃত্যু হ্রাস, শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি, টিকাদানে সাফল্য, মৎস্য উৎপাদন ও পশুপালনে সাফল্য— এসবই শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের অবদান। তাঁদের এসব অবদানের স্বীকৃতি নেই। দিনরাত পরিশ্রম করে যে প্রকৌশলীরা একটি প্রকল্প শেষ করেন, সে প্রকল্প উদ্বোধনের সময় সেই প্রকৌশলীরা অনুষ্ঠানস্থলের তৃতীয় সারিতেও স্থান পান না। বরং প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের সব কৃতিত্ব দেওয়া হয় যাঁরা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন, তাঁদের। আর সামান্য ভুল-ত্রুটির দায়দায়িত্ব প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের নিতে হয়।

আন্ত-ক্যাডার বৈষম্যের তালিকা বা বিশেষায়িত ক্যাডার বা নন-ক্যাডারে কর্মরত ব্যক্তিদের বঞ্চনা, অসহায়ত্ব, বিপন্নতার তালিকা অনেক দীর্ঘ। লেখক তাঁর লেখার শেষে ঠিকই লিখেছেন: বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করার জন্য যাঁদের সরকার তৈরি করেছে, তাঁরা যেন নিজ ক্ষেত্রেই মর্যাদা ও সন্তুষ্টির সঙ্গে কাজ করতে পারেন, সেদিকেও নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ হিসেবে পদোন্নতি, গ্রেড-বৈষম্য, জনবল কাঠামো, বেতনবৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য কিছুটা হ্রাস করা প্রয়োজন।

মো. কবির আহমেদ ভূঞা: সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, গণপূর্ত অধিদপ্তর, সাবেক প্রেসিডেন্ট, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ ও সাবেক সভাপতি, ২৬ ক্যাডার বিসিএস সমন্বয় কমিটি।

আরও পড়ুন