সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনার পরপরই প্রকাশ পেল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও। দুটি ঘটনায় মানুষ ধাক্কা খেয়েছে, তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এখন এ-ও দেখছি যে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্ষণের খবর আসছে এবং সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। যেন একটা ঢেউয়ের মতো ব্যাপার।
কেন এমন হয়? এই হারে ধর্ষণের ঘটনা কি তাহলে সব সময়ই ঘটতে থাকে; যেগুলো চাপা পড়ে থাকে, কোথাও প্রকাশ পায় না? কোনো ধর্ষণের ঘটনা সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার তৈরি করলেই কি আড়ালে থাকা ঘটনাগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে? এর সদুত্তর আমাদের জানা নেই।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে জনপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা সামাল দিতে সরকার আইন কঠোর করেছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এখন মৃত্যুদণ্ড। আগে ছিল যাবজ্জীবন। ধর্ষণের অপরাধে কতজনের সেই শাস্তি হয়েছে? এসব মামলার বিচার নিষ্পত্তির হার ৩ শতাংশের মতো আর শাস্তির হার ১ শতাংশ। শাস্তি বাড়লে কি মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়বে? শাস্তি কতটা কঠোর, তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে বিচার পাওয়া যাচ্ছে কি না, সমাজে বিচার পাওয়ার মতো পরিস্থিতি আছে কি না। বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে যদি সমস্যা থাকে তবে দণ্ড কঠিন করে কী লাভ!
এত দিনে আমরা জেনে গেছি, বেগমগঞ্জের নারী নির্যাতন ঘটনার মূল হোতা দেলোয়ার হোসেন। ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ-যুবকের নামে সেখানে একটি বাহিনী সক্রিয় ছিল। তারা একজন নারীর ওপর যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা সবাই জানতে পেরেছে ঘটনার মাসখানেক পর, যখন ভিডিওটি ফেসবুকে প্রকাশ পেয়েছে, তখন। এই ভিডিও বের না হলে দেলোয়ার এবং তাঁর বাহিনী যে এখনো বেগমগঞ্জ দাপিয়ে বেড়াত, তাতে কারও কোনো সন্দেহ আছে কি?
এখন দেলোয়ার ও তাঁর বাহিনীর খোঁজখবর বের হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও নানা তথ্য পাচ্ছেন। প্রথম আলো লিখেছে, দেলোয়ার দুই বছর আগে অস্ত্র ও গুলিসহ জনতার হাতে ধরা পড়েছিলেন। হাত বাঁধা অবস্থায় তাঁর সে ছবির সন্ধান মিলেছে। পিটুনি দিয়ে জনতা তাঁকে পুলিশে তুলে দিয়েছিল। ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, সেই অস্ত্র কোথায় কেউ জানে না। পুলিশ যে দায়িত্ব পালন করেছে তা হচ্ছে, আহত দেলোয়ারের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। তারা দেলোয়ারকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছিল। এলাকার লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুয়ায়ী বাকি কাজটি করেছেন স্থানীয় সাংসদ মামুনুর রশীদের লোকজন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁরা দেলোয়ারকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন।
দেলোয়ারের বাড়ি থেকেও অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। তাঁর কিছু হয়নি, কিন্তু যিনি অস্ত্রের খবর দিয়েছিলেন তাঁকে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হয়েছিল। একটি জোড়া খুনের মামলার আসামি হয়েছিলেন দেলোয়ার কিন্তু সেই মামলা থেকেও রেহাই পেয়েছেন। এতসব ঘটনা ঘটিয়ে যিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পেরেছেন, তিনি দিনে দিনে বেপরোয়া হবেন এটাই স্বাভাবিক। বেগমগঞ্জের সেই নারীর ওপর নির্যাতন চালানোর সময় ঘুণাক্ষরেও নিশ্চয়ই তাঁর মনে হয়নি এর জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হবে।
এখন যিনি বেগমগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তিনি ১৪ মাস আগে এখানে যোগ দিয়েছেন। দেলোয়ার বাহিনী বা তাঁর অপকর্ম সম্পর্কে থানার ওসির কিছুই অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা গেল, ১৪ মাস দায়িত্ব পালন করার পরও তিনি দেলোয়ার সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন না। প্রথম আলোর প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, দেলোয়ার কখনো অস্ত্রসহ আটক হয়েছিলেন কি না, তা তিনি জানেন না। তবে হত্যা ও মারামারির মামলায় তাঁকে ধরতে ওসি কয়েক দফা অভিযান চালিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। সেসব ‘অভিযান’ যে ব্যর্থ হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ‘মডেল’ থানার ওসির কাছে কেন তাঁর এলাকার একজন অপরাধীর সব তথ্য থাকবে না। তিনি কেন জানবেন না দেলোয়ার অস্ত্রসহ কখনো আটক হয়েছিলেন কি না। কোনো থানায় নতুন ওসি যোগ দিলে তাঁর প্রথম কাজটি হচ্ছে এলাকার অপরাধীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া, তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা। বেগমগঞ্জ থানায় এই ওসি ১৪ মাস পার করেছেন, কিন্তু দেলোয়ারের কীর্তিকলাপের অনেক কিছুই তাঁর অজানা। দেলোয়ারকে ধরতে অভিযান চালানোর কথা তিনি বলেছেন। একজন ওসি খুনের মামলার কোনো আসামিকে ধরতে যাবেন, অথচ তাঁর সম্পর্কে আগেভাগে দরকারি সব তথ্য জোগাড় করবেন না, এটা কেমন পেশাদারি আচরণ!
পুলিশ কি দেলোয়ারদের মতো অপরাধীদের সম্পর্কে আসলেই খোঁজখবর রাখে না? নাকি জেনেও একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে এমন ভাব করতে হয় যে তিনি জানেন না। দেলোয়ারের বিষয়ে পুলিশের অনেক কিছু অজানা থাকা বা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার পেছনের কারণটি অনুমান করা কোনো কঠিন কাজ নয়। দেলোয়ারের প্রতি ক্ষমতাসীন দল, স্থানীয় সাংসদ ও তাঁর লোকজনের সমর্থনের অভিযোগ আছে। এখন আমরা কাকে দুষব? পুলিশকে, নাকি রাজনীতি ও ক্ষমতার আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টাকে?
রাজনীতি যদি পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে না দেয় বা রাজনীতি ও পুলিশের স্বার্থ যদি মিলেমিশে এক হয়ে যায়, তাহলে দেলোয়ারদের ঠেকাবে কে? কোনো ওসি চাইলেই কি স্থানীয় সাংসদ বা জনপ্রতিনিধির স্বার্থে আঘাত লাগে এমন কিছু করতে পারেন? বা তাঁদের পছন্দের কেউ অপরাধ করলে তাঁকে ধরতে পারেন? পুলিশের ওসিদের নিয়োগ-বদলির পেছনে যে স্থানীয় সাংসদের বড় ভূমিকা থাকে, সেটা কে অস্বীকার করবে? এমন অবস্থায় পুলিশ ও জনপ্রতিনিধির স্বার্থকে এক করে ফেলাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। দুই পক্ষের জন্যই উইন উইন পরিস্থিতি। পুলিশ তাই অনেক কিছু ‘জানে না’ বা জেনেও জানে না। পুলিশ যদি না জানে বা জানতে না চায়, তা হলে দেলোয়ার বা ধর্ষকদের বিচারপ্রক্রিয়া চলবে কীভাবে, শাস্তি হবে কেমন করে? শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না যাবজ্জীবন, সেটা তো অনেক পরের প্রশ্ন।
এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপসম্পাদক