পরাজিত প্রার্থীরা নির্বাচনে পরাজয়ের প্রকৃত কারণ আড়াল করার জন্য একটা কার্যকর আবরণ পেয়ে গেছেন। বাহ্যিক এই আবরণটির নাম ‘দলীয় কোন্দল’। পত্রপত্রিকায়ও ম্যাড়মেড়ে এই শব্দ দুটির বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। সাধারণের বা দলের শীর্ষ মহলের চোখে ঠুলি পরানোর জন্য এ ধরনের ‘মিথ্যা আবরণ’ (‘ফলস ফ্ল্যাগ’) বেশ কার্যকরও বটে।
প্রার্থী হিসেবে পরাজয়ের পেছনে আমার বা আমার দলের কোনোই দায় নেই, দায় কেবল দলীয় কোন্দলের—সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এমন অলীক সত্যের জাল বোনা শুধু যে নির্বাচনে পরাজয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নয়। দলীয় বিবেচনায় বড় পদে অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তিরাও এখন নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য ‘দলীয় কোন্দলতত্ত্ব’কে কাজে লাগাচ্ছেন। ‘আমি পারছি না কারণ, আমার দলের লোকেরাই আমার পেছনে লেগেছে’, এমন মন্তব্য ইদানীং বাজারে বেশ প্রচলিত। কিন্তু এই মন্তব্যই কি সব? ব্যক্তির অযোগ্যতা বা ব্যক্তি ও দলের কৃতকর্ম কি এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আড়ালে চলে যাচ্ছে না?
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সেখানে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে প্রধানত তিনটি ধারা রয়েছে। এই ধারা বা বিভাজন কেন্দ্রীয়ভাবে যেমন আছে, তেমনই আছে তৃণমূল পর্যায়ে। ক্ষমতার পালাবদল দুই দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় এবং নিকট ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা থাকায় দলীয় বিভিন্ন ধারার ওপর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
একই দলের মধ্যে তিনটি ধারা হলো: এক. সাংসদ, মন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা। দুই. সাংসদ ও মন্ত্রী হতে পারেননি বা কোনো পদে বসতে পারেননি, কিন্তু বসতে চান, এমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা। এ ধারাটি আবার একাধিক ভাগে বিভক্ত হতে পারে। তিন. এই ধারাটি মূলত দলের কর্মী-সমর্থকদের ধারা। উচ্চাভিলাষ নেই, এমন ব্যতিক্রমী ত্যাগী নেতারাও সাধারণভাবে এ ধারার সঙ্গে আছেন। দলীয় আদর্শ রক্ষা এবং সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় ধারাটিই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দলে মতামত প্রতিফলনের ক্ষেত্রে এ ধারাটি বর্তমানে গুরুত্বহীন এবং অবহেলিত।
তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, নানা চাপ, হতাশা, ক্ষোভ ইত্যাদি কারণে দলের অভ্যন্তরে এই তৃতীয় ধারাটি এখন প্রায় নীরব ও অদৃশ্য। কোনো এলাকায় গেলে সাদা চোখে দেখে মনে হতে পারে দলের কর্মী-সমর্থকেরা কেউ আছেন এক নম্বর ধারার সঙ্গে, আবার কেউ বা আছেন দুই নম্বর ধারায়। কিন্তু একটু গভীরে দৃষ্টি মেললে বোঝা যায়, দলের বিশাল কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী এক ও দুই নম্বর ধারার প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ। দলের ক্ষুব্ধ এই গোষ্ঠী তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগে। বিশেষ করে দল ক্ষমতায় থাকলে এই প্রক্রিয়া বেশি কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে ভোটকেন্দ্রেই যাচ্ছেন না, অনেকে নেতিবাচক ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী পরাজিত প্রার্থীরা যে এ সত্য একেবারে জানেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য দোষ চালান করে দিচ্ছেন দলীয় প্রতিপক্ষ বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ঘাড়ে। এতে একদিকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তাঁদের পরাজয়ের কারণকে যেমন ‘যুক্তিগ্রাহ্য’ করা যাচ্ছে, অন্যদিকে এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছেও একধরনের মুখরক্ষা সম্ভব হচ্ছে।
দলে প্রায় অদৃশ্য এই তৃতীয় ধারার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রধান অভিযোগ হলো, উল্লেখিত এক নম্বর ধারার নেতাদের বেশির ভাগই এখন আর বিন্দুমাত্রও দলের আদর্শের ধার ধারেন না। তাঁরা ক্ষমতাকে কেবল তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করছেন। সাধারণ কর্মীদের ভালো-মন্দ বা দলীয় কর্মসূচির প্রতি তাঁদের ছিটেফোঁটাও আগ্রহ নেই। দলের সুবিধাভোগী অংশটি সংগত কারণেই এই ধারায় গিয়ে মিশেছে।
দলের দুই নম্বর ধারা সম্পর্কেও তৃতীয় ধারার লোকদের ধারণা প্রায় একই রকম। এই ধারার নেতারা যেকোনো উপায়ে এক নম্বর ধারার নেতাকে টেনে নামিয়ে নিজে ক্ষমতার ভাগ পেতে ব্যস্ত থাকছেন। দলের আদর্শ ও সাধারণ কর্মীদের প্রতি এ ধারার নেতৃত্বেরও কোনো নজর নেই। বরং তাঁদের মনোযোগ কেবল ক্ষমতাসীনকে ঘায়েল করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশলের দিকে। এঁরা দলের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কান ভারী করার কাজেও সিদ্ধহস্ত। দলের সুবিধাভোগী আর একটি অংশ, যারা বর্তমানে সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত, তারা আবার গিয়ে জুটছে এই ধারায়।
দলের ওপর মহলে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকছে পদে আসীন ধারার নেতৃত্বের। দুই নম্বর ধারা বা ‘বিদ্রোহী’ ধারাও শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছে। প্রচারমাধ্যমও প্রধানত তুলে ধরছে এই দুই ধারার কথাই। এ অবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চাপা পড়ে যাচ্ছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় ধারাটির মতামত।
তৃতীয় ধারায় রয়েছে প্রধানত দলের সমর্থকগোষ্ঠী। এদের মধ্যে পদের মোহ কম। ফলে এই ধারায় প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। কোনো কোনো ত্যাগী নেতা এই ধারায় থাকলেও যোগ্যতার মূল্যায়ন না হওয়ায় তাঁরা অনেক আগেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। আবার সত্য উচ্চারণ করতে গিয়ে নিজ দলের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতৃত্বের হাতে নিগৃহীতও হচ্ছেন অনেকে। এ অবস্থায় কান্ডারিহীন তৃতীয় ধারার রূপটি থেকে যাচ্ছে অপ্রকাশ্যই। অথচ সমাজে সাধারণ ভোটারদের ওপর এই ধারার কর্মীদের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। দলের নেতৃত্বের নানা অপকর্মের বয়ান এদের মাধ্যমেই সাধারণ ভোটারদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ব্যালট বাক্সের ধাক্কাটাও আসছে এভাবেই।
ইদানীং নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যাপারে দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৃতীয় ধারার মতামতের কোনো প্রতিফলন ঘটছে না বললেই চলে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের বেলায় গুরুত্ব পাচ্ছে মন্ত্রী বা তাঁর ওপর পর্যায়ের নেতাদের মতামত। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সাংসদদের মতামতকে। এতে উভয় ক্ষেত্রে মনোনয়ন পাচ্ছেন নানা ‘স্বার্থের হিসাবে’ যুক্ত মন্ত্রী বা সাংসদদের বলয়ের লোকেরা। এ ধরনের প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে যেমন অযোগ্য, তেমনই কোথাও কোথাও অপরিচিত ও বিচ্ছিন্ন। কারও আবার দলের কাজকর্মে কোনো ভূমিকাই নেই। ফলে স্বাভাবিক কারণেই এই প্রার্থীরা নির্বাচনে পরাজিত হচ্ছেন। এদিকে এসব প্রার্থীর পৃষ্ঠপোষকেরা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে শীর্ষ মহলে পরাজয়ের কারণ হিসেবে ‘দলীয় কোন্দলতত্ত্ব’ উপস্থাপন করছেন।
নির্বাচনে নিজ বলয়ের প্রার্থী মনোনয়নে প্রভাব বিস্তার ছাড়াও অনেক মন্ত্রী, বিশেষ করে সাংসদদের ব্যাপারে দলের কর্মী-সমর্থকদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে সব থেকে গুরুতর অভিযোগ হলো আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ। সমর্থকদের মতে, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে এবং থানা-পুলিশসংক্রান্ত ঘটনায় সাংসদদের প্রভাব একচেটিয়া। এসবকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের লেনদেন এখন প্রায় প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সব থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, নিজ দলের কর্মী-সমর্থকেরাও এই আর্থিক দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। কর্মী-সমর্থকদের চাকরি বা থানা-পুলিশের জন্য কেবল টাকা গুনলেই চলছে না, প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে তাঁদের অন্য দলের লোকদের সঙ্গে। বেশি টাকা দিলে সৌভাগ্যের চাকা ঘুরছে অন্য দলের দিকেই। ঠিকাদারি, ব্যবসা, স্থানীয় হাট-বাজারের ইজারা, মামলা-মোকদ্দমা এসব ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কর্মী-সমর্থকদের মতে, এখন আর ‘দলবাজি’ কথাটি প্রযোজ্য নয়, এখন চলছে ‘ব্যক্তিবাজি’ বা ‘গোষ্ঠীবাজি’, ক্ষমতা যার প্রধান কেন্দ্র।
কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, নিজের গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত না থাকায় সাধারণ কর্মীদের হয়রানি বা তাঁদের মামলা-মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, বিপদের সময় কর্মীদের বা এলাকার মানুষের পাশে না দাঁড়ানোর অভিযোগও সাংসদ-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে রয়েছে। অনেক সাংসদ আবার নিজের কৃতকর্ম দ্বারা কর্মী-সমর্থক থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন যে এলাকায় প্রভাব বিস্তার তো দূরের কথা, সাধারণের সামনে দাঁড়ানোর সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন। কর্মী-সমর্থকদের মতে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে গত দেড় বছরে দেশে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটেছে প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচিত সাংসদদের এই দুর্বলতার কারণেই।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এসব কৃতকর্ম সার্বিকভাবে দল বা সরকারের অনেক সাফল্যকেই ম্লান করে দিয়েছে। কেবল দলীয় কোন্দলের ধুয়া তুলে এখন আর তাই সত্যকে আড়াল করা সম্ভব নয়। দেশের এই ক্রান্তিকালে শীর্ষ মহলকে ভাবতে হবে দল কি কেবল আগাপাছতলা ক্ষমতামুখী হয়েই থাকবে, নাকি আদর্শের দিকে ফিরে তাকাবে? দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে, দলকে আদর্শমুখী রাখতে হলে তৃণমূল পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার কোনো বিকল্প নেই। বিরাজমান অবস্থার পরিবর্তন আনতে না পারলে সহসাই এমন সময় আসবে যখন দলের আহ্বানে কেউই আর সাড়া দেবে না।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।