পরমতসহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতা

ধর্ম
ধর্ম

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও ধর্মের অনুসারী ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শনকে পরমতসহিষ্ণুতা বলে। ইসলামের পরিভাষায় কারও কথায়, কাজে বা আচার-ব্যবহারে কোনো রকম ক্রোধান্বিত বা উত্তেজিত না হয়ে ধৈর্য, সংযম, সমঝোতা ও সহনশীলতার পন্থা অবলম্বন করে স্বীয় কর্তব্য পালন করাই পরমতসহিষ্ণুতা।
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই মানুষকে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও সহিষ্ণুতা গ্রহণ করতে হবে। পরমতসহিষ্ণুতার মধ্যে থাকবে না কোনো জাগতিক স্বার্থ, থাকবে না কোনো লৌকিকতা, এ সহিষ্ণুতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ পরকালে চরম সুখ ও পরম শান্তি লাভের প্রত্যাশায় পার্থিব জীবনে মৃত্যু পর্যন্ত অটলভাবে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করবে ও ধৈর্য ধারণ করবে। জগতে এমন কোনো কাজ নেই, যা সহিষ্ণুতা বা সমঝোতা ব্যতিরেকে সমাধান করা যেতে পারে। তাই জাতীয় জীবনে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা সুরক্ষায় সহিষ্ণুতার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানবজাতির একটি মহৎ গুণ। মানুষ দুনিয়াতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে ছোট-বড় নানা প্রকার দুঃখ-কষ্ট, বাধাবিপত্তি, দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ ও বিসংবাদের সম্মুখীন হয়। কিন্তু মানুষ ধৈর্য ধারণপূর্বক এসব বাধাবিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট অতিক্রম করে স্বীয় লক্ষ্য অর্জন করে থাকে।
সফলতা ও উদ্দেশ্য সিদ্ধির ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে, মানবজীবনের চরম লক্ষ্য হলো সফলতা অর্জন করা; কিন্তু যার মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাব রয়েছে সে সফলতা অর্জন করতে এবং উদ্দেশ্য সাধন করতে সক্ষম হয় না। পক্ষান্তরে সহিষ্ণুতার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়। বাধাবিপত্তি, দুঃখ-কষ্ট, হাহুতাশ ও কান্নাকাটিতে মানুষকে ভারাক্রান্ত না হয়ে সহিষ্ণুতার মাধ্যমে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে এবং বিপদ-আপদে ও বালা-মুসিবতে ধৈর্য ধারণপূর্বক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলবে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ওপর এমন দুঃখ-কষ্ট চাপিয়ে দিয়ো না, যাতে আমি ধৈর্যচ্যুত হই, বরং তুমি আমার ওপর রহম করো।’ যেমনভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৬) এভাবে ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করলে আল্লাহ তার ওপর খুশি হন এবং তার জীবনে সফলতা আসে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান জীবনচরিত ছিল উদারতা, শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জন্মভূমি মক্কাবাসীর ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অত্যাচার-নির্যাতন চরমে পৌঁছালেও তিনি কিছুতেই সহিষ্ণুতা হারাননি। হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা ও তায়িফ বিজয়ের সময় যে অতুলনীয় ক্ষমার আদর্শ প্রদর্শন করেছেন, বিশ্বের ইতিহাসে এর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। তাঁর সার্থক ও নির্মল ক্ষমাসুন্দর উদারতা, শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার সুমহান চরিত্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ঐতিহাসিক সৈয়দ আমীর আলীর ভাষায়, ‘বিজয়ের মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) সব যন্ত্রণা ভুলে গেলেন, সব অত্যাচার ক্ষমা করেন এবং মক্কাবাসীর প্রতি সর্বজনীন ক্ষমা ঘোষণা করেন। কোনো গৃহ লুণ্ঠিত হলো না বা কোনো স্ত্রীলোক অপমানিত হলো না।’
একজন মানুষের নিজস্ব শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানলব্ধ পাণ্ডিত্যের কূপমণ্ডূকতায় আবদ্ধ না থেকে পাশাপাশি অন্যান্য বুদ্ধিমান বিবেকসম্পন্ন জ্ঞানী লোকের পাণ্ডিত্যের অভিজ্ঞতা ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, ধৈর্যের সঙ্গে শ্রবণ করা, সহনশীল হয়ে অন্যের পরামর্শ অভিমতসমূহ প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া এবং সর্বোপরি পারস্পরিক মতামতের সারবত্তা ও যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করা ও বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে এর মধ্যে সঠিক যুক্তিযুক্ত প্রমাণিত হবে, তা সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করা এবং প্রয়োজনে নিজের অভিমত ত্যাগ করেও অন্যের মতামত সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়ে প্রকৃতপক্ষে উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতা এক ও অভিন্ন। একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ পরমতসহিষ্ণু হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে একজন পরমতসহিষ্ণু মানুষকে উদার হতে হয়।
যে সমাজে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা যত বেশি, সে সমাজে অপরাধ প্রবণতা তত কম। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার ক্ষমতাদান সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।’ (বুখারি) ইসলামের আলোকে ধৈর্য, সংযম, উদারতা ও সহিষ্ণুতা মানুষের ইমানকে পরিপক্ব করে। ইমানের যতগুলো শাখা-প্রশাখা রয়েছে, তার মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা অন্যতম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ইমানের অর্ধাংশ।’ (আবু নাঈম) তিনি আরও বলেছেন, ‘সহিষ্ণুতার পুরস্কার জান্নাত।’ (বায়হাকি)
সমাজজীবনে মানুষ যেকোনো সময় বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে পারে, সে জন্য তাকে পশ্চাৎপদ হলে চলবে না, বরং সহনশীলতার সঙ্গে সেসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিরপেক্ষতার সঙ্গে যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করতে হবে। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষের যুক্তিসংগত মতামতকে পরামর্শের ভিত্তিতে প্রাধান্য দিতে হবে। সংলাপ, আলাপ-আলোচনা, পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এভাবে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী যদি সব ক্ষেত্রে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সহিষ্ণুতার সঙ্গে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা যায়, তাহলে সমাজজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা ও ঐক্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পরমতসহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতার অনুশীলন ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত জীবনে সাফল্য আশা করা যায় না। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তিশৃঙ্খলা ও কল্যাণকর জীবনযাপনের জন্য এটি একান্ত অপরিহার্য।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: শিক্ষক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]