আশির দশকের কথা। সে সময়ের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় তার্কিক এক লেখক ঠিক করলেন বিয়ে করবেন। তাঁর এক সহপাঠী ছাত্রীর বাড়ি ছিল গোদাগাড়ীতে। সেই সহপাঠীর অন্যত্র বিয়ে ঠেকানোর সেটাই ছিল একমাত্র পথ। তিনি যে বাম দলটি করতেন, সেই পার্টি তাঁকে দলের সার্বক্ষণিক কর্মী হতে বলেছে। বিয়ের বাজারে বিতার্কিক, লেখক, নেতা—এসব কোনো যোগ্যতা নয়। সেই মেয়েটির পাত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া পুলিশের সাবইন্সপেক্টরের তুলনায় এসব নিতান্তই তুচ্ছ পরিচয়। তখন সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল লোহানী তখন রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার কর্ণধার। প্রেমিক ছেলেটির লেখা প্রায় প্রতি সপ্তাহে ছাপা হয় তাঁর কাগজে। কামাল লোহানী ওরফে দুলাল ভাই তাঁকে বললেন, ‘গিয়ে বলবে তুমি সাংবাদিক—দৈনিক বার্তার সাংবাদিক। তুমি তো আমাদেরই লোক। ধরো তোমার চাকরি হয়ে গেছে।’ দিনক্ষণ ঠিক করে যাওয়ার আগেই পাক্কা নিয়োগপত্র পেয়ে যান ছেলেটি।
তো পাত্রপক্ষ পাত্রীর বাড়িতে হাজির। আসরের নামাজের পরে মেয়ের নানা এলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। জজকোর্টে পেশকারি করে তখন তিনি অবসরে। তাঁর কথার ওপর কেউ কথা বলে না। তিনি মন দিয়ে দুই পক্ষের কথাবার্তা শুনলেন। শেষে এক নুরানি হাসি দিয়ে বললেন, ‘সবই শুনলাম। পাত্রের লেখার হাত ভালো, বক্তৃতায় ফার্স্ট, ক্লাসে ফার্স্ট, ভালো সাংবাদিক। সবই বুঝলাম, কিন্তু চাকরিটা কী করে?’ নানার মনে হয়েছে, সাংবাদিকতা কোনো পেশা নয়, যা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করানো যায়।
৪০ বছর আগের সে কথা এত দিন পরে আবার মনে পড়ল এক তরুণ সাংবাদিকের পোস্ট দেখে। লকডাউনের সপ্তাহ খানেক আগে বিয়ে করেছেন। মেস ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু বাসা খুঁজে পাচ্ছেন না। করোনার যন্ত্রণায় পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে বাসা খালি হয়ে গেছে। মাস্কের পরেই বোধ করি ‘টু লেট’ বা ‘বাড়ি ভাড়া হবে’ লেখা টিনের ফালি বেশি বিক্রি হচ্ছে আজকাল। ভাড়া কমিয়ে দিয়ে দু–এক মাসের ভাড়া পরে দেওয়ার কথা বলেও ভাড়াটেদের আটকে রাখতে পারছেন না বাড়িওয়ালারা। এদিকে এক ফেসবুক ব্যক্তিত্ব ফেসবুকে ঘোষণা করেছেন, তাঁর মালিকানাধীন সব ফ্ল্যাটের ভাড়া মওকুফ করে দেবেন। ঘোষণা দিয়ে তিনি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছেন। এর বিপরীতে দেখা গেছে, দু-এক জায়গায় বাড়িওয়ালা ভাড়াটের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন। ডাক্তার এবং করোনায় আক্রান্ত ভাড়াটেদের বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। শেষে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এত সবের পরেও সাংবাদিকদের জন্য কোনো ভালো খবর নেই।
ভাল খবর নেই উকিল, পুলিশ এমনকি কোচিং বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষকদেরও। অনেক বাড়িওয়ালা উকিলদের এড়িয়ে চলেন। উকিলেরা নাকি কথায় কথায় আইন দেখান। তবে সবাই যে এমন করেন সেটা হলফ করে বলা যাবে না। আবার সব সাংবাদিক বাসা ভাড়া নিয়ে হুজ্জোত না করলেও কেউ কেউ তো তা করেন, সাংবাদিক পরিচয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। একজন এরকম করলে রটে যায় বদনাম। এসব দেখে এক উকিল দেখি সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে লিখেছেন আয়কর উপদেষ্টা। এতদিন ছিলেন দেওয়ানি উকিল। কোভিডের কারণে কতো ভাবেই না বাঁচার চেষ্টা করতে হচ্ছে মানুষকে। পেশা ছাড়াও ধর্মটাও অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনেন কোনও কোনও বাড়ির মালিক। এমনকি ফ্ল্যাট বাড়ির সমিতিও এ ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। এটা এই উপমহাদেশের সর্বত্র কমবেশি আছে।
মাসের পর মাস ভাড়াটে না পেয়ে অনেক বাড়িওয়ালার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার কাহিনি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু সাংবাদিকদের বাসা ভাড়া দিচ্ছেন না। একজন মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘না খেয়ে থাকব, তবু আপনাদের ভাড়া দেব না। আমার খুশি।’ যে তরুণ সাংবাদিকের কথা বলছিলাম, শেষ পর্যন্ত তিনি বাসা খুঁজে পেয়েছেন। সোজা ছিল না সে রাস্তা। তাঁর কথাতেই শোনা যাক বিস্তারিত, ‘অনেক খোঁজার পর অর্থনীতি ও পছন্দ মিলে একটা বাসা পছন্দ হলো। বাসার মালিক তেজগাঁওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন বলে জানালেন। মুঠোফোনে বাসা ভাড়া ঠিক হলো, এরপর তিনি আমার কর্মজীবন নিয়ে জানার আগ্রহ দেখালেন। আমি সোজা উত্তর দিলাম, আংকেল, আমি একটা পত্রিকায় সাংবাদিকতা করি। অফিস তেজগাঁওয়ে। আমার সাংবাদিক পরিচয় জানার পর মুঠোফোনের ওপার থেকে অন্তত ১০ সেকেন্ড কোনো উত্তর এল না। কিছুক্ষণ পর জানালেন, তিনি স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বিকেলে বাসা ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
‘যথারীতি আমি বিকেলে তাঁকে ফোন দিয়ে পরিচয় দিলাম। তখন তিনি বললেন, ভাড়াসহ সব ঠিকই আছে। কিন্তু সমস্যা হলো সাংবাদিকতা নিয়ে। তিনি আমার ব্যবহারে আকৃষ্ট, এ জন্য আগে তিনি নিজের থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া কমিয়েছেন। কিন্তু পরে আমার পরিচয় জানার পর আর ভাড়া দিতে চাইছেন না। শেষে আমার জোরাজুরিতে তিনি জানতেই চাইলেন, আমি “সাংবাদিক” না “এডিটর”। আমি বললাম, “সাব-এডিটর” (সহসম্পাদক)। তখন তিনি কিছুটা নরম হলেন। এর কারণ তিনিই হয়তো ভালো জানেন...
‘এবার বাসায় প্রবেশের নিয়মনীতি নিয়ে শুরু হলো কথা। রাত ১১টার পর কোনোভাবেই বাসায় প্রবেশ করা যাবে না। আমি বললাম, সপ্তাহে এক দিন দেরি হবে। তিনি বললেন, “একে তো সাংবাদিক, আবার দেরি করে আসবেন, বাসা হবে না।” পরে অনেকক্ষণ তাঁকে বোঝালাম। শেষে অগ্রিম ভাড়ার টাকা নিতে রাজি হলেন, রাতে বাসায় ডাকলেন। বাসায় গিয়ে আবার একই প্রশ্ন, “আপনি সাংবাদিক, নাকি এডিটর।” তখন আমার অফিসের একটা ভিজিটিং কার্ড উনাকে দিলাম। কার্ডে সাব-এডিটর দেখে তিনি অগ্রিম টাকা নিলেন। অবশেষে ওই ফ্ল্যাট আমি ভাড়া নিতে সক্ষম হলাম।’
ওপরে বর্ণিত তরুণ সাংবাদিকের চেয়ে সিনিয়র এক সাংবাদিক কিন্তু বাসা পাচ্ছেন না। গত পাঁচ মাস তিনি হন্যে হয়ে বাসা খুঁজছেন। তাঁর এক গোঁ, কিছুতেই তিনি ভণিতা করবেন না। সাংবাদিকতায় যথেষ্ট নামযশ আছে তাঁর। নামকরা কবিদের সারিতেও আছেন তিনি। আল্লাহ দিলে বেতন নিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তা নেই। তারপরও তিনি বাড়িওয়ালাদের কাছে ‘নো চয়েস’।
অনেক আগে একজন কথাশিল্পী সাংবাদিক রগড় করে লিখেছিলেন, ‘সাংবাদিকদের আবার বাড়িভাড়া লাগে?’ তারপর আবার নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এভাবে, ‘মোটামুটি সব সাংবাদিকেরই একটা বাসায় থাকতে হয়। বেশির ভাগ সাংবাদিকের সঙ্গেই তার বাড়িওয়ালার মোটামুটি একটু খারাপ সম্পর্ক থাকে। মাসের ১৫ তারিখে যে বেতন পায়, সে কি আর সবার মতো ৫ তারিখের মধ্যে বেতন দিতে পারে?’ এটা ঠিক, সব সাংবাদিক মাসের ১ তারিখে বেতন পান না। পান দু–এক সপ্তাহ পরে। কিন্তু ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে গেছেন—এমন নজির আছে কি? তারপরও সাংবাদিকদের ভাড়া দিতে এত ভয় কেন? কেন তাঁদের দ্বিতীয় পরিচয় দিতে হবে? তবে কি বাড়িওয়ালা মাত্রই গড়বড় কোনো কাজ করেন? যেটা প্রকাশ হলে বিপদ? তাই সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলা? অনেক বাড়িওয়ালাই ভাড়ার রসিদ দেন না। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকে ভাড়া নেন না। এসবই রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার ফন্দি। গত ২৫ বছরে ঢাকায় বাসাভাড়া বেড়েছে ৪ থেকে ৭ গুণ, কিন্তু ভাড়াটের মর্যাদা ও অধিকার কি বেড়েছে, না কমেছে?
তবে ভালো বাড়িওয়ালাও আছেন। যারা ভাড়াটের পেশা বা ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেন না, খোঁজেন একজন সজ্জন ব্যাক্তি। ভাড়াটে যেমন খোঁজেন ভালো বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালারাও তেমন খোঁজেন ভালো ভাড়াটে। তবে ভালো’র সংজ্ঞা নিয়ে নানা মত আছে। সবাই মনে মনে সেই সাপই খোঁজে যার দাঁত নাই, যে করেনাকো ফোঁসফাঁস।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]